গীবত ও চুগলখোরী
Sabet Bin Mukter
“যদিও গীবত করা ভালো না, তারপরও একটা সত্য কথা বলি…”।
এভাবেই আমরা গীবত শুরু করি। কারো এমন কথা যা তার সামনে বললে যদি সে কষ্ট পায় ওই একই কথা যদি তার অনুপস্থিতিতে আরেকজনের সামনে বললে তাকেই গীবত বলে যদিও কথাটি সত্য হোক না কেন। সত্য হলে গীবত আর বানিয়ে বললে হবে অপবাদ। যা গীবতের চেয়েও মারাত্মক। দেশে ইসলামি আইন থাকলে অপবাদ দেয়ার শাস্তি তাকে পেতে হত, আখিরাতেও তো আছেই। আবু হুরায়রা (রাদিঃ) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ(ﷺ)বলেছেন, গীবত কাকে বলে, তোমরা জান কি? সাহাবিগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই(ﷺ)ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার কোন ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তাই গীবত। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যে দোষের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? উত্তরে রসুলুল্লাহ(ﷺ)বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি অবশ্যই তার গীবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ। (সহিহ মুসলিম) গীবতের পরিণামঃ গীবত ইসলামি শারিয়াতে হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
‘ধ্বংস তাদের জন্য, যারা অগ্র-পশ্চাতে দোষ বলে বেড়ায়।’ (সূরা হুমাজাহঃ১) কোন মুসলিম ভাইয়ের গীবত করাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতো নিকৃষ্ট অপরাধ বলেছেন। যার গীবত করা হচ্ছে তার গুনাহগুলো গীবতকারীর কাছে চলে যাবে আর গীবতকারীর নেক আমলগুলো যার গীবত করা হয়েছে তার কাছে চলে যাবে। এভাবে হাশরের ময়দানে প্রচুর আমল নিয়ে আসলেও শুধুমাত্র গীবত করার কারণে আমাদের আমলগুলো অন্যদেরকে দিয়ে দিতে হবে। “মুমিনগণ, তোমরা অনেক ধারণা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”[সূরা হুজুরাতঃ ১২] গীবত ও চুগলখোরীর পার্থক্যঃ মানুষের অজান্তে দোষ বর্ণনার নাম গীবত। যদিও উক্ত দোষ তার মাঝে বর্তমান থাকে। চুগলখোর ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে মানুষের মাঝে ঝগড়া লাগানোর উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করে। গীবতকারী ও চুগলখোরের মধ্যে পার্থক্য এই যে, চুগলখোরের মধ্যে ঝগড়া লাগানোর ইচ্ছা থাকে। আর গীবতকারীর মধ্যে তা থাকা শর্ত নয়। গীবতকারী ও চুগলখোরেরা মানুষের মধ্যে বিচ্ছেদ ও ঝগড়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করে থাকে। মানুষের পারস্পরিক ভালবাসাকে শত্রতায় পরিণত করে। তারা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক এবং বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। তাদেরকে আপনি দেখতে পাবেন যে, একজনের কাছে একরকম এবং অন্যজনের কাছে অন্যরকম চেহারা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। তারা নিজেদের ইচ্ছামত যখন যা খুশী তাই বলে থাকে। কবরের আযাবের অন্যতম কারণ হল চুগলখোরী করা। ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রসুলুল্লাহ(ﷺ) মদীনা বা মক্কার কোন একটি বাগানের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তথায় তিনি দু’জন এমন মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলেন, যাদেরকে কবরে শাস্তি দেয়া হচ্ছিল। রসুলুল্লাহ(ﷺ)বললেন, তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে অথচ বড় কোন অপরাধের কারণে আজাব দেয়া হচ্ছে না। অতঃপর তিনি বললেন, তাদের একজন প্রস্রাব করার সময় আড়াল করত না। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগাত। এরপর রসুলুল্লাহ(ﷺ) একটি কাঁচা খেজুরের শাখা আনতে বললেন। অতঃপর উক্ত খেজুরের শাখাটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করে প্রত্যেক কবরের উপর একটি করে রেখে দিলেন। রসুলুল্লাহ(ﷺ)কে জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কেন এরকম করলেন? উত্তরে তিনি বললেন, হয়ত খেজুরের শাখা দু’টি জীবিত থাকা পর্যন্ত তাদের কবরের আজাব হালকা করা হবে।(বুখারী) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ(ﷺ)বলেছেন, যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হল, তখন আমি তামার নখ বিশিষ্ট একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম। তারা নখগুলো দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষত-বিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এসমস্ত লোক কারা? জিবরীল (আঃ) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মান-সম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গীবত ও চুগলখোরী করত। (আবু দাউদ) কাতাদা (রঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে যে, কবরের আজাবের এক তৃতীয়াংশ হবে গীবতের কারণে, এক তৃতীয়াংশ পেশাব থেকে সাবধান না থাকার কারণে এবং এক তৃতীয়াংশ চুগলখোরীর কারণে। যেহেতু গীবতকারী এবং চুগলখোর মিথ্যা কথাও বলে থাকে, তাই সে মিথ্যাবাদীর শাস্তিও ভোগ করবে। সামুরা বিন জুন্দুব (রাঃ) হতে বর্ণিত রসুলুল্লাহ(ﷺ)এর স্বপ্নের দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, অতঃপর আমরা এমন এক লোকের কাছে উপস্থিত হলাম, যাকে চিৎ করে শায়িত অবস্থায় রাখা হয়েছে। একজন লোক লোহার বড়শী হাতে নিয়ে তার মাথার পাশে দাড়িয়ে আছে। দাঁড়ানো ব্যক্তি শায়িত ব্যক্তির মুখের একদিকে লৌহাস্ত্র প্রবেশ করিয়ে পিছনের দিকে ঘাড় পর্যন্ত চিরে ফেলছে। নাকের ছিদ্র দিয়ে প্রবেশ করিয়ে অনুরূপ করা হচ্ছে এবং চোখের ভিতর প্রবেশ করিয়েও অনুরূপ করা হচ্ছে। একদিকে চিরে শেষ করে অন্যদিকেও অনুরূপ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় দিকে চিরে শেষ করার সাথে সাথে প্রথম দিক আগের মত হয়ে যাচ্ছে। আবার প্রথম দিকে নতুন করে চিরা হচ্ছে। হাদীছের শেষাংশে এসেছে, রসুলুল্লাহ(ﷺ)জিজ্ঞেস করলেন, কি অপরাধের কারণে তাকে এভাবে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? জিবরীল (আঃ) বললেন, এহল এমন লোক যে সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়েই মিথ্যা কথা বলত এবং সে মিথ্যা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তো। (বুখারী) আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) রসুলুল্লাহ(ﷺ)হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে দু’জনের নিকট দু’রকম কথা বলবে, কিয়ামতের দিন তার আগুনের দু’টি জিহ্বা হবে। (আবু দাউদ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ(ﷺ)কে বলতে শুনেছি, যার সুপারিশ আল্লাহর নির্ধারিত কোন দন্ডবিধি বাস্তবায়ন করার প্রতিরোধ হয়ে দাড়াল, সে আল্লাহর সাথে সংগ্রামে লিপ্ত হল। যে ব্যক্তি জেনে-বুঝে ও অন্যায়ভাবে কারো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হল, সে তা থেকে বিরত থাকার পূর্ব পর্যন্ত আল্লাহর ক্রোধের ভিতরে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন মুমিন সম্পর্কে এমন কথা বলবে, যা তার ভিতরে নেই, সে যদি তা বর্জন করে তাওবা না করে মৃত্যু বরণ করে, আল্লাহ্ তাকে রাদাগাতুল খাবালে প্রবেশ করাবেন। তার উক্ত কথার প্রায়শ্চিত্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে অবস্থান করবে। (আবু দাউদ) আয়িশা (রাঃ) রসুলুল্লাহ(ﷺ)হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে তার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে, (গীবত করবে) কিয়ামতের দিন গীবতকারীর সামনে গীবতকৃত ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় উপস্থিত করা হবে এবং বলা হবে তুমি মৃত অবস্থায় তার গোশত ভক্ষণ কর যেমনভাবে জীবিতাবস্থায় তার গোশত ভক্ষণ করতে। অতঃপর সে অতি অনিচ্ছা সত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে। (বুখারী) কেউ গীবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধ করবে সাধ্যমতো। আর যদি প্রতিরোধের শক্তি না থাকে তবে তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকবে। কেননা, ইচ্ছাকৃতভাবে গীবত শোনা নিজে গীবত করার মতোই অপরাধ। সাহাবি মায়মুন (রাদিঃ) বলেন, একদিন স্বপ্নে দেখলাম এক সঙ্গী ব্যক্তির মৃতদেহ পড়ে আছে এবং এক ব্যক্তি আমাকে তা ভক্ষণ করতে বলছে। আমি বললাম, আমি একে কেন ভক্ষণ করব? সে বলল, কারণ তুমি অমুক ব্যক্তির সঙ্গী গোলামের গীবত করেছ। আমি বললাম, আল্লাহর কসম আমি তো তার সম্পর্কে কখনো কোনো ভালোমন্দ কথা বলিনি। সে বলল, হ্যাঁ, এ কথা ঠিক। কিন্তু তুমি তার গীবত শুনেছ এবং সম্মত রয়েছ। বেঁচে থাকার উপায়ঃ গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করা। কেননা, রসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, ‘দ্বীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা করা।’ দ্বিতীয়ত, আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া। যেমন আল্লাহ সূরা হাশরের ৯ নম্বর আয়াতে এইরশাদ করেছেন, ‘তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে।’ তৃতীয়ত, অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া। চতুর্থত, মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি করে অধ্যয়ন করা। আমাদের সব সময় আল্লাহ তায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন অনুগ্রহ করে গীবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন। এ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রে। কেননা, রসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,
‘বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো না। কেননা, তুমি যদি ঠিক থাক, তবে আমরা সঠিক পথে থাকব। কিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাব। (তিরমিজি)
রসুলুল্লাহ(ﷺ) অন্যত্র বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’ (বুখারি)
যেসব ক্ষেত্রে গীবত করা বৈধঃ
ইমাম নববীর(রহঃ) মতে, যদিও গীবত করা হারাম, কোন কোন পরিস্থিতিতে গীবত করার অনুমোদন রয়েছে যখন তা কোন মঙ্গলের জন্য করা হয়ে থাকে৷ গীবত করার এ ক্ষমতা কেবলমাত্র একটা ন্যায়সঙ্গত ও বৈধ কারণেই প্রদান করা যাবে, অন্যথায় এর অনুমতি দেয়া যাবে না৷ নিম্নের ছয়টি কারণের যে কোন একটি কারণে গীবত করা যেতে পারে:
১.জুলুম/নিপীড়নের বিচার চাইতেঃ যে ব্যক্তি নিপীড়িত হয়েছে, তার জন্য এই অনুমতি রয়েছে যে, সে তার অবস্থা সম্পর্কে শাসক বা বিচারককে বা অন্য যে কাউকে অবগত করতে পারে, যার ক্ষমতা রয়েছে তাকে জালিমের বিরুদ্ধে সুবিচার দেয়ার ৷ তাকে উল্লেখ করতে হবে, “অমুক লোক আমার প্রতি অন্যায় করেছে” এবং “সে আমার সাথে এই করেছে” এবং “সে আমাকে দমিয়ে রেখেছে এভাবে” বা এরকম আরো তথ্য৷
২.একটি মন্দকে পরিবর্তন করা এবং পাপীকে সঠিক পথের দিকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য চাওয়াঃ একজন ব্যক্তির উচিত, যার পক্ষে কোন মন্দ কাজ থামানো সম্ভব তাকে বলা, “অমুক ব্যক্তি এরকম করেছিল, ফলে আমি তাকে তা থেকে বিরত রাখি” বা এরকম কিছু ৷ তার লক্ষ্যই হবে মন্দকে সম্পূর্ণরূপে দূর করা ৷ যদি এ ধরনের কোন উদ্দেশ্য না থাকে, তবে তার জন্য কোন কথা উল্লেখ না করাই উত্তম
৩.ফতোয়া (ইসলামী বিধান) চাওয়া/জানাঃ একজন ব্যক্তির উচিত একজন মুফতীকে (যিনি ফতোয়া দিতে পারেন) বলা: “আমার বাবা” বা “আমার ভাই” বা “এই এই ব্যক্তি আমার সাথে এইরূপ অন্যায় করেছে ৷ তার কি এটা করার অধিকার রয়েছে?” – “কিভাবে আমি সেটা বন্ধ করতে পারি এবং আমার উপর থেকে জুলুম বন্ধ করে আমার অধিকার আদায় করতে পারি?” এবং এরকম আরো তথ্য ৷ এমনিভাবে, একজন বলতে পারে যে, “আমার স্ত্রী এরূপ করেছে” বা “আমার স্বামী এরূপ করেছে” এবং এরকম আরো তথ্য ৷ প্রয়োজনের তাগিদে এ ধরনের ফতোয়া চাওয়া অনুমতিযোগ্য, কিন্তু সাবধানতা অবলম্বনের জন্য যে কারো উচিত এভাবে বলা, “একজন ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন – যে এরূপ করেছে?” বা “একজন স্বামীর ব্যাপারে” বা “একজন স্ত্রী সম্পর্কে যে এরূপ করেছিল” (আমার স্ত্রী এভাবে না বলে) ইত্যাদি ৷ এই পদ্ধতিতে, কাউকে নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করেই লক্ষ্য অর্জন করা যায় ৷ যাহোক, একজন ব্যক্তির নামোল্লেখ করা এরকম পরিস্থিতিতে অনুমোদিত এ হাদীসের ভিত্তিতে যে, হিন্দ (রা.) একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) কে জানান, “বস্তুত, আবু সুফিয়ান (তার স্বামী) একজন কৃপণ লোক ৷” এবং আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে একথা বলা থেকে বিরত রাখেননি ৷
৪.মুসলিমদের পাপ সম্পর্কে সতর্ক করা এবং উপদেশ দেয়াঃ এর বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে: কাউকে হাদীস বর্ণনা ও সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে অনির্ভরযোগ্য ঘোষণা করা ৷ ইজমা (মুসলিম স্কলারদের ঐক্যমত) অনুযায়ী এটি করা জায়েয ৷ বরং গুরুত্বের ভিত্তিতে এটি কখনও কখনও অবশ্য কর্তব্য হয় ৷ আরেকটি অবস্থা হচ্ছে, যখন কোন ব্যক্তি কারো সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়, বিবাহ, ব্যবসা, সম্পত্তি হস্তান্তরের সময়, দৈনন্দিন লেনদেন ও যেকোন কিছু হস্তান্তরের সময় বা অনুরূপ কোন পরিস্থিতে – আপনার জন্য ফরয সেই ব্যক্তিকে অপর ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে অবগত করা, যার সঙ্গে সে লেনদেন করতে যাচ্ছে – উপদেশের লক্ষ্যে ৷ যদি আপনার উদ্দেশ্য এ কথা বলাতেই অর্জিত হয় যে “তার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেনে জড়ানো আপনার জন্য মঙ্গলজনক নয়” বা এটা বলাতেও, “আপনার এটা করা উচিত নয়” বা এধরনের কিছু, তবে সেটুকুতেই সারতে হবে; তাই বলে ঐ লোকটির অন্যান্য (প্রসঙ্গ বহির্ভূত) খারাপ দোষগুলো সম্পর্কে জানানো যাবে না ৷ আর যদি এতে কাজ না হয়, তবে আপনি নির্দিষ্টভাবে লোকটির অবস্থা সম্পর্কে তাকে অবগত করতে পারেন ৷
আর একটি অবস্থা হচ্ছে, যখন আপনি কাউকে এমন কোন লোকের কাছ থেকে কোন কিছু কিনতে দেখেন, যে নাকি চুরি, ব্যভিচার বা মদ্যপানের মত অপরাধের সাথে জড়িত ৷ তখন ক্রেতাকে এ সম্পর্কে অবগত করানো আপনার কর্তব্য, যেহেতু তিনি জানেন না ৷ এমনকি, এটা তখনও প্রযোজ্য যখন আপনি জানেন লোকটি যে বস্তুটি কিনতে যাচ্ছে তা ত্রুটিযুক্ত ৷
আর একটি ব্যাপার হচ্ছে যে, যখন আপনি কোন শিক্ষার্থীকে (দ্বীনের ক্ষেত্রে) দেখেন একজন বিদ‘আতী বা পথভ্রষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করছে এবং আপনি তার ক্ষতির আশংকা করেন ৷ তখন আপনি অবশ্যই সেই ছাত্রকে উপদেশ দেয়ার লক্ষ্যে সে ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে অবগত করবেন ৷ এক্ষেত্রে অনেক মানুষই ভুল করে থাকে, কেননা ব্যক্তিটি যার সম্পর্কে উপদেশ দিচ্ছেন তার ব্যাপারে তিনি ঈর্ষাপরায়ণ হতে পারেন বা শয়তান তাকে ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে, এভাবে যে, তিনি ভাবতে পারেন যে তিনি যেটা করছেন তা হচ্ছে নসীহত এবং সমবেদনা প্রকাশ করা ৷
সর্বশেষে যে অবস্থাটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, যখন কোন ব্যক্তি কোন নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করছে এবং সে তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না কেননা সে উপযুক্ত নয় বা সে একজন অমনোযোগী বা পাপী ইত্যাদি ৷ এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তির উচিত অন্যরা যারা তার উপর নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাদের নিকট বিষয়টি জানানো, যাতে তাকে এই পদ থেকে সরানো যায় এবং একজন উপযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া যায়৷ অথবা, যাদের সে ব্যক্তিটির উপর ক্ষমতা রয়েছে তারা যেন তার সম্পর্কে জানতে পারেন, যেন তার দ্বারা যাতে ক্ষতি সাধন না হয় তার ব্যবস্থা করতে পারেন বা তাকে ভাল হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন বা অন্য কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারেন ৷
৫.যখন কেউ উন্মুক্তভাবে মন্দকর্ম বা বিদআতী কাজে লিপ্ত থাকে- এর উদাহরণ হচেছ যখন কেউ খোলাখুলিভাবে মদপান করে, লোকের টাকা আত্মসাৎ করে এবং তাদের নিকট থেকে অন্যায়ভাবে ট্যাক্স নেয় ইত্যাদি ৷ ফলে জনসাধারণের সামনে ঐ ব্যক্তিটি যে সকল কাজ করে, তা নিয়ে আলোচনা করা বা কথা বলা বৈধ ৷ কিন্তু ঐ লোকের অন্যান্য দোষত্রুটি সম্পর্কে আলোচনা করা নিষিদ্ধ যতক্ষণ না সেগুলো ঐ ক্যাটাগরীতে পড়ে, যে সকল কারণে গীবত করা জায়েয ৷
৬.কোন ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা – কোন ব্যক্তি যদি লোকজনের নিকট তার ডাক নামে পরিচিত থাকে, যেমন ‘ঝাপসা চোখ বিশিষ্ট যিনি’, ‘যিনি খোঁড়ান’, ‘বধির লোকটি’, ‘অন্ধ লোকটি’, ‘টেরা চক্ষু বিশিষ্ট’, ‘চ্যাপ্টা নাকওয়ালা’, ইত্যাদি ৷ তাহলে তাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য এভাবে বলা জায়েয ৷ যাহোক, তাকে হেয় করার জন্য এরকম নামকরণ করা নিষিদ্ধ ৷ যদি তাকে অন্য কোনভাবে চিহ্নিত করা যায়, তবে তাকে সেভাবেই চিহ্নিত করা উচিত ৷
এগুলো হচ্ছে সেই ছয়টি অবস্থা যে ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয, যদি তা আলেমগণ যেভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে করা হয়ে থাকে ৷ সহীহ হাদীস থেকেও এসব পরিস্থিতে গীবত করার অনুমোদন পাওয়া যায় ৷
সহীহ আল বুখারী ও মুসলিমে আয়িশা (রা) বলেছেন, একজন লোক রাসূল (সা.) নিকট তার গৃহে প্রবেশের অনুমতি চাইলে, তিনি বললেন: “তাকে আসার অনুমতি দাও, এবং সে তার আত্মীয়স্বজনের জন্য কত খারাপ ভাই ৷” আল বুখারী এ হাদীসটিকে গীবত করার ক্ষেত্রে প্রমাণস্বরূপ ব্যবহার করেছেন।
ইবন মাসুদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহর রাসূল (সা.) যুদ্ধলব্ধ সম্পদের একাংশ বন্টন করছিলেন, তো একজন আনসারী বলল, “আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মোহাম্মদ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছা রাখে না (অর্থাৎ, তিনি ন্যয্যভাবে বন্টন করেননি) ।” ফলে আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট গেলাম এবং তাঁকে ব্যাপারটি জানালাম ৷ তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে গেল (অর্থাৎ তিনি রাগান্বিত হলেন) এবং বললেন: “আল্লাহ তা’আলা মূসা (আ)-এঁর উপর রহম করুন ৷ বস্তুত তিনি এর চেয়ে গুরুতরভাবে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি ধৈর্যশীল ছিলেন ।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
তাছাড়া হিন্দ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসটি রয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “বস্তুত আবু সুফিয়ান হচ্ছে একজন কৃপণ ব্যক্তি ৷” এবং এ হাদীসটি যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ফাতিমা বিনতে কায়েসকে (রা.) বললেন (দু’জন পানিপ্রার্থীর প্রসঙ্গে): “মুয়াবিয়ার ক্ষেত্রে, সে হচ্ছে খুবই দরিদ্র এবং আবু জাহম এর ব্যাপারটি হচেছ, সে তার কাঁধ থেকে লাঠি নামায় না অর্থাৎ, ‘সে তার বউদের মারধর করে’ ৷” (সহীহ মুসলিম)
[ইমাম নববী(রহ) রচিত রিয়াদুস স্বলিহিন কিতাব থেকে সংকলিত]
মহান আল্লাহ আমাদেরকে গীবত, চুগলখোরী, হিংসা, অহংকার, মিথ্যা, প্রতারণা ইত্যাদি সকল আমলবিধ্বংসী চরিত্র থেকে হিফাজত করুন। আমিন।