এই অংশটি নেয়া হয়েছে শায়খ সালিহ আল-উসাইমীনের আদি ইবনে হাতিমের হাদীসের আলোচনা থেকে, যখন আদি ইবনে হাতিম আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলেন,
“তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও দরবেশগণকে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে৷” (সূরা তওবাঃ৩১)
এরপর, আদী বিন হাতিম (তিনি তখনো মুসলিম হননি) জিজ্ঞেস করলেন: হে মুহাম্মাদ !(সঃ) তারা তো পন্ডিত ও দরবেশগণের ইবাদত করে না ,তাহলে তাদেরকে কিভাবে রব গ্রহণ করা হলো? মুহাম্মাদ (সঃ) বললেন: ‘পন্ডিত ও দরবেশগণ আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম এবং যা হারাম করেছেন তা হালাল করে
আল্লাহর আইন পরিবর্তন করে না? এবং জনগন কি তা অন্ধভাবে মানেনা?
আদী বিন হতিম উত্তর দিলেন; জি হ্যাঁ মানে,তখন মুহাম্মাদ (সঃ) বললেন; ইহাই হলো তাদের ইবাদত করা‘৷
(মুসনাদে আহমাদ,তিরমিযি একে হাসান বলেছেন)৷
হাদীসটি থেকে যে বিষয়গুলো সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা যায়ঃ
যে আনুগত্য ইবাদতের অর্থ হিসেবে করা হয়ে থাকে তা একটি বিশেষ ধরণের ওবুদিয়াহ।
আল্লাহর আইনের সাথে বিরোধপূর্ণ হওয়ার পরেও যদি কারণ আনুগত্য করা হয় তাহলে প্রকৃতপক্ষে তার ইবাদত করা হয়। কারণ আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যম হল আনুগত্য, আর আনুগত্যের মাধ্যমেই আল্লাহর প্রতি ইবাদত করা হয়।
আলেম ও বান্দাদের মধ্যে যারা আল্লাহর আইনের বিরোধিতা করছে তাদের অনুসরণ করার অর্থ হল তাদেরকে প্রভূ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা [আল্লাহকে বাদ দিয়ে]।
জ্ঞাতব্যঃ নেতা,সর্দার বা আলেম যারা হালালকে হারাম কিংবা হারামকে হালাল করেছেন তাদের অনুসরণ করা হলে একজন ব্যক্তি তিনটি পরিস্থিতির যেকোন একটি কারণে তা করে থাকে;
(১) সে তাদের অনুসরণ করে কারণ তাদের মতামতের প্রতি সে সন্তুষ্ট , তাদের মানব রচিত মতবাদকে সে অগ্রাধিকার দেয় এবং আল্লাহর আইনের প্রতি সে অসন্তুষ্ট- এই ব্যক্তি একজন কাফির কারণ সে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানকে অপছন্দ করেছে যার পরিণামে আল্লাহ তার আমলকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন। কাফির ব্যতীত কেউই তার আমলকে অসার,ব্যর্থ হিসেবে দেখতে পায় না।
(২) সে তাদের অনুসরণ করছে বটে, কিন্তু আল্লাহর আইনের প্রতি সে সন্তুষ্টচিত্ত এবং সে জানে এটাই সর্বোত্তম এবং দেশ ও জনগণের জন্যে সবচেয়ে মানানসই এরপরও সে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণে সে আল্লাহর আইনের বদলে তাদের অনুসরণ করছে, উদাহরণস্বরূপ, হতে পারে সে একটি দায়িত্বশীল পদের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। এ ধরণের ব্যক্তিকে কাফির ঘোষণা দেয়া যায় না, বরং সে একজন ফাসিক।
(৩) সে অনুসরণ করছে কিন্তু সে জানে না এবং তার জন্য ইলম অর্জনের কোন উপায় নেই , তাই সে তাদের মতামতকে সঠিক মনে করে অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করছে। এ ধরণের ব্যক্তির উপর কোন দোষ দেয়া যায় না কারণ সে তাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই অনুসরণ করেছে এবং সে অভিযোগ থেকে রেহাইপ্রাপ্ত। আর এ কারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,(হাদীসের ইংরেজি তরজমা) “indeed whosoever is given a verdict not based upon knowledge then his sin is upon the one who gave him the verdict.” যদি আমাদের এটা বলতে হয় যে অন্য কারও ভুলের জন্য এই ব্যক্তিটিও পাপী তাহলে তা তার প্রতি যুলুম ও অন্যায়ের দিকে চালিত হবে, এবং তখন কোন ব্যক্তি অন্য কাউকে বিশ্বাস করবে না কারণ অন্য মানুষের ভুলের দায়ভার তাকেও বহন করতে হবে।
{হাদীসটি বর্ণিত আছে মুসনাদে আহমাদে (২/৩২১,৩৬৫), আবু দাউদ (৪/৬৬), ইবন মাজাহ (১/২০), আদ-দারিমি(১/৫৩) এবং আল-হাকিম(১/১২৬) বলেছেন হাদীসটি সহীহ, ইমাম আয যাহাবীও অনুরূপ বলেছেন}
যদি এ প্রশ্ন করা হয়, কেন দ্বিতীয় দলভুক্ত [লোকদের] কাফির ঘোষণা করা হল না? তবে আমি এর উত্তরে বলতে চাই,যদি তাদের সম্পর্কে একথা বলা হয় যে তারা কাফির, তাহলে প্রত্যেক ব্যক্তির কুফরি অবিশ্বাস সম্পর্কেও একথা বলা জরুরী হয়ে পড়বে, যারা কোন একটি পাপ কাজ সম্পাদন করে একথা জেনে যে, তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে এবং এটাও জানে যে [সে যার বিরুদ্ধাচারণ করেছে] এটা আল্লাহর আইন।
একটি ফায়দাঃ আল্লাহ সেসব লোকদের সম্পর্কে বর্ণণা করছেন যারা আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে বিচার বা ফয়সালা করে না, তিনটি বর্ণণায়ঃ
“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের”। [সূরা মায়িদা ৪৪]
“যেসব লোক আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না তারাই জালেম”। [সূরা মায়িদা ৪৫]
“যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদনুযায়ী ফয়সালা করে না, তারাই পাপাচারী”। [সূরা মায়িদা ৪৭]
আলেমগণ এ বিষয়ে পৃথক পৃথক মত দিয়েছেন। কাজেই মতামত হল, বস্তুত এই বর্ণণাগুলো এক এবং সমধর্মী বিষয় বর্ণণা করছে কারণ আল্লাহর আয়াত অনুসারে যে একজন কাফির সে একজন যালিমও বটে,
“বস্তুতঃ কাফেররাই প্রকৃত যালেম”। (সূরা বাকারাহ ২৫৪)
[অনুরূপভাবে একজন কাফির] হল ফাসিক আল্লাহর আয়াত অনুসারে।
“পক্ষান্তরে যারা অবাধ্য [পাপী] হয়, তাদের ঠিকানা জাহান্নাম” । [সূরা সাজদা ২০]
এমন মতামতও দেয়া হয় যে এগুলো হচ্ছে সুস্পষ্টভাবে পৃথকীকৃত বর্ণণা এবং এগুলো পরিস্থিতি অনুসারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকেঃ
কাজেই [একজন ব্যক্তি] কাফির হয়ে যায় তিনটি ক্ষেত্রে,
(১) যখন সে বিশ্বাস করে নেয় যে, আল্লাহ যা কিছু অবতীর্ণ করেছেন তা ব্যতীত অন্য আইন দিয়ে শাসন করা যায় ।এর সপক্ষে দলীল পাওয়া যায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বর্ণণায়;
“তারা কি জাহেলিয়াত আমলের ফয়সালা কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?” (সূরা মায়িদা:৫০)
(২) যা কিছু আল্লাহর আইনকে বিরোধিতা করে তা মূলত অজ্ঞতা বা জাহেলিয়াহ’র আইনকে প্রতিষ্ঠিত করে। [সপক্ষে আরও দলীল হল] আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করার কোন অনুমতি নেই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ইজমা রয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি মনে করে যে, আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য আইন দ্বারা শাসন করা যেতে পারে এবং এটাকে হালাল মনে করে সে ব্যক্তি নিশ্চিতভাবে এই ইজমাকে প্রত্যাখান করে এবং এ ধরণের ব্যক্তি একজন কাফির, মুরতাদ নয়। উদাহরণস্বরূপ, এটা সেই ব্যক্তির মত যে মনে করে ব্যভিচার বা মদ হালাল অথবা রুটি,দুধ ইত্যাদি হারাম।
(৩) যখন সে বিশ্বাস করে আল্লাহর আইন ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা আল্লাহর আইন দিয়ে শাসন করার সমতুল্য, কিংবা যখন সে বিশ্বাস করে আল্লাহর আইনের চেয়ে অন্য কোন আইন দিয়ে শাসন করা উত্তম, এ ধরণের মানুষের জন্য দলীলস্বরূপ আল্লাহ নিজেই বলছেন, আল্লাহ অপেক্ষা বিশ্বাসীদের জন্যে উত্তম ফয়সালাকারী কে?” [মায়িদা:৫০ ]অর্থাৎ আয়াটিতে বর্ণিত হচ্ছে, আল্লাহর আইন হল আইনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম। এটি পরবর্তীতে প্রমাণিত হচ্ছে আরেকটি আয়াতে যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলছেন, “আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্টতম বিচারক নন?” [সূরা তীন ৮]
কাজেই যখন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই হচ্ছেন বিচারকদের মধ্যে সর্বোত্তম বিচারক এবং তিনি হচ্ছেন শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ তখন যে ব্যক্তি এটা দাবী করে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো আইন আল্লাহর আইনের সমতুল্য কিংবা তার থেকেও উত্তম তাহলে সে ব্যক্তি একজন কাফির কারণ সে কুর’আনকে অস্বীকার করেছে।
যখন সে যালিম হয়ে যায়
যখন সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে বিচার করা হচ্ছে সর্বোত্তম বিচার এবং যমীনে বিচরণশীল বান্দাদের জন্যে সবচেয়ে উপকারী এবং এটা প্রয়োগ করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু ঘৃণা এবং হিংসার কারণে সে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের বাইরে অন্য আইনের দ্বারা বিচার করে- এ ধরণের লোক একজন যালিম।
যখন সে ফাসিক হয়ে যায়
যখন সে তার নিজের প্রবৃত্তিকে অনুসরণ করে। উদাহরণস্বরূপ; সে এমন একজন লোকের পক্ষে শাসন বা বিচার করলো যে তাকে ঘুষ প্রদান করেছে, অথবা সে তার একজন আত্মীয় বা বন্ধু, অথবা সেই শাসক কোন একটি চাহিদা পূরণের জন্য তার সহচরদের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহর আইন বা বিচার আদর্শ এবং এটা মেনে চলা বাধ্যতামূলক – এই বিশ্বাস করার পরে যে ব্যক্তি উল্লেখিত কাজগুলো করবে তখন সেই ব্যক্তিকে ফাসিক দলভুক্ত করা যায়। যদিও সে একজন যালিমও বটে, তাকে ফাসিক বর্ণনা করা অধিক মানানসই।
সবচেয়ে শক্তিশালী মত হচ্ছে দ্বিতীয়টি যেখানে বলা হচ্ছে এই বর্ণণাগুলো খুব সুস্পষ্টভাবে পৃথকীকৃত এবং পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
আর যে শরীয়াহ’র বিধানকে পরিত্যাগ করে এবং মানব রচিত বিধানকে গ্রহণ করে কিন্তু এটা জানে যে এই বিধানগুলো আল্লাহর ফয়সালার সাথে সাংঘর্ষিক- তখন সেই ব্যক্তি শরীয়াহ’র বিধানকে প্রতিস্থাপন করল। কাজেই সে একজন কাফির-এর কারণ সে এটা বিশ্বাস করেই এই সাংঘর্ষিক বিধানগুলো নির্বাচন করেছে এবং শরীয়াহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে যে, লোকদের জন্যে এবং দেশের জন্যে আল্লাহর শরীয়াহ অপেক্ষা তার পছন্দনীয় মানব রচিত বিধানগুলো উত্তম। কিন্তু যখন আমরা বলছি যে, সে একজন কাফির, তখন তার অর্থ হচ্ছে এই কাজটি অবিশ্বাস-কুফরের দিকে চালিত করে।
যাই হোক, যে এ ধরণের আইন-কানুনগুলো তৈরী করে তার কোন অজুহাত থাকতে পারে- উদাহরণস্বরূপ, সে ধোঁকাবাজির শিকার হতে পারে; যেমন, তাকে বলা হয়েছে যে এগুলো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক নয় অথবা এগুলো এমন কিছু বিষয় যা মানুষের উপকার করার জন্যে করা যেতে পারে (মাসা’লিহ আল-মুরসালা), অথবা ধোঁকা এভাবেও দেয়া হতে পারে যে, এগুলো এমন কিছু বিষয় যা ইসলাম মানুষের রীতি-নীতির উপর ছেড়ে দিয়েছে।
আর এমন অনেক আলেমও আছেন- যদিও তারা ভুলের উপর আছেন- যারা বলছেন সামাজিক লেনদেন(মুয়ামালাত) নাকি এমন একটি বিষয় যা ইসলাম অনুসারে পরিচালিত হয় না, এবং এটা নাকি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্যে যে সময়ে যা পাওয়া যায় তা অনুসারেই পরিচালিত,নির্দেশিত হয় । কাজেই যদি সময়ের দাবী বা পরিস্থিতি এমন হয় যে,সুদভিত্তিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠিত করতে হবে কিংবা জনগণের নিকট থেকে কর আদায় করতে হবে তাহলে এগুলো নিয়ে কোন সমস্যা নেই!
এ ধরণের দাবীর অসারতা ও ভুল সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কাজেই এই লোকগুলো যদি ইজতিহাদ করে থাকে,আল্লাহ যেন তাদের ক্ষমা করেন। অন্যথায়, তারা এমন একটি পরিস্থিতিতে আছেন, যা খুব বিপদজনক এবং তাদের জন্য মানানসই উপাধি হচ্ছে ‘সরকারী আলেম’ , ‘দ্বীনের আলেম’ নন।
শায়খ মুহাম্মদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন
‘আল-ক্বাউল আল-মুফিদ ‘আলা
কিতাব আত-তাওহীদ’ [২/২৬৩-২৬৯]
ইংরেজি অনুবাদ – আবু রুমায়সা [Triod Publications]
বাংলা অনুবাদঃ সরল পথ