প্রশ্ন: আমরা অনেকেই একে অপরকে বলে থাকি যে, আমি উমুককে আল্লাহর জন্য ভালবাসি। কিন্তু দেখা গেল, তার মতাদর্শ আমার সাথে মিল না হলে প্রথম দিকে ঐ ভালবাসাটা থাকলেও পরবর্তীতে তা ফিকে হয়ে যায়। আমাদের মতাদর্শ ও চিন্তা-চেতনার সাথে যাদের মিল তাদের বা যারা আমাদের কাছের তাদের প্রতিই আমাদের ভালবাসাটা বেশি। কিন্তু আমাদের বিপরীত মতাদর্শে বিশ্বাসী বা দূরের কারোর প্রতি আমাদের মনে সেরকমটা হয় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে মনে বিদ্বেষও তৈরী হয়।
আমার প্রশ্ন হলো, ‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’ কথাটার প্রকৃত অর্থ বা সংজ্ঞা কি? এটা কি রকম হওয়া উচিত? কিভাবে আমরা আমাদের বিপরীত মতাদর্শীদেরকেও আল্লাহর জন্য ভালবাসতে পারি? এ জাতীয় প্রয়োজনীয় তথ্য জানানোর জন্য অনুরোধ রইল।
উত্তর:
‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা’ ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আকীদাগত বিষয়। ইসলামের একে ‘আল ওয়ালা ওয়াল বারা’ও বলা হয়। তাই এ সম্পর্ক সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরি।
❒ ১মত: ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা’র মর্যাদা:
এ বিষয়ে বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হল। যথা:
? যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ভালাবাসবে আর আল্লাহর জন্যই রাগ বা দুশমনী পোষণ করবে সে প্রকৃত ঈমানের স্বাদ উপভোগ করবে:
“আনাস বিন মালেক রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ طَعْمَ الْإِيمَانِ: مَنْ كَانَ يُحِبُّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَمَنْ كَانَ اللهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَمَنْ كَانَ أَنْ يُلْقَى فِي النَّارِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يَرْجِعَ فِي الْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنْقَذَهُ اللهُ مِنْهُ
“তিনটি জিনিস যার মধ্যে পাওয়া যাবে, সে ঈমানের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে।
১) যে ব্যক্তি কোনো মানুষকে একমাত্র আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে।
২) যার নিকট আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অন্য সব কিছু হতে অধিক প্রিয় হবে
৩) এবং আল্লাহ তাকে কুফরি থেকে রক্ষা করার পর পুণরায় কুফরিতে ফিরে যাওয়ার চেয়ে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া তার নিকট অধিক প্রিয় মনে হবে”।[ সহীহ বুখারি, হাদিস: ২১, ৬০৪১ ও সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৪৩, ৬৮ ]
? আল্লাহর জন্য ভালবাসা ও আল্লাহর জন্য রাগ বা ঘৃণা পোষণ করা ঈমানের সবচেয়ে মজবুত বন্ধন:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
« إِنَّ أَوْثَقَ عُرَى الْإِيمَانِ أَنْ تُحِبَّ فِي اللهِ، وَتُبْغِضَ فِي اللهِ »
“ঈমানের সবচেয়ে সুদৃঢ় বন্ধন হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করা”।[জারির ইবন আব্দুল হামিদ এর সনদে ইমাম বাইহাকী শুয়াবুল ঈমানে হাদিসটি বর্ণনা করেন। হাদিস নং ১৪]
? এটি আল্লাহর নিকট অতি পছন্দনীয় আমল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
« إِنَّ أَحَبَّ الْأَعْمَالِ إِلَى اللهِ الْحُبُّ فِي اللهِ، وَالْبُغْضُ فِي اللهِ »
“নিশ্চয় আল্লাহর নিকট উত্তম আমল হল, আল্লাহর জন্য ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা পোষণ করা”।[আবু দাউদ, হাদিস: ৪৫৯৯]
❒ ২য়ত: আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাগ বা ঘৃণা পোষণ করার অর্থ:
? ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে ভালবাসা’র অর্থ হল, আল্লাহর কারণে ভালবাসা বা আল্লাহকে কেন্দ্র করে ভালবাসা। কাউকে আমি ভালবাসবোএ করণে যে, সে আল্লাহকে ভালবাসে, আল্লাহর ইবাদত করে, তার মধ্যে ঈমান ও তাকওয়া বিদ্বমান রয়েছে…। এ ভালবাসার পেছনে দুনিয়ার কোন স্বার্থ নেই।
? ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যই রাগ বা ঘৃণা পোষণ’ করার অর্থ হল, কোন ব্যক্তিকে আমি ঘৃণা করব বা তার সাথে দুশমনী পোষণ করব এ কারণে যে, সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে ঘৃণা করে বা তাদের সাথে দুশমনী পোষণ করে, আল্লাহর সাথে শিরক ও কুফুরীতে লিপ্ত, সে বিদআতে নিমজ্জিত, পাপাচার মত্ত, তার মধ্যে ঈমান ও তাওয়া নেই, কুরআন-সুন্নাহর বরখেলাক কাজ করে..ইত্যাদি।
সুতরাং আল্লাহভীরু, দ্বীনদার ও সৎলোক, ও আহলে ইলমদের কেবল আল্লাহর জন্যই পরিপূর্ণভাবে ভালবাসতে হবে। আর কাফের-মুশরিক, বিদআতী, মুনাফিক এবং আল্লাহর দুশমনদেরকে পরিপূর্ণভাবে ঘৃণা করতে হবে এবং আন্তরিক দুশমনী পোষণ করতে হবে। তাদের সাথে আন্তিরক ভালবাসা স্থাপন করা জায়েয নয়। এটি ঈমানের দাবি।
অবশ্য কাফের-মুশরিকদের সাথে দুনিয়াবী স্বার্থে, যেমন ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, আত্মীয়ার বন্ধন, কুটনৈতিক বিষয় ইত্যাদি কারণে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখায় কোন দোষ নেই।
আর যার মধ্যে কিছু নেকির কাজ আছে আর কিছু গুনাহর কাজ আছে, যারা কিছু কুরআন সুন্নাহর অনুকুলে কাজ করে আর কিছু কুরআ্ন-সুন্নাহর বিপরীত কাজ করে অর্থাৎ যার মধ্যে ভালো-মন্দ দু ধরণেরই আচরণ বিদ্যমান রয়েছে তাদেরকে যতটুকু নেকিরকাজ বা ইসলামের আদর্শ আছে ততটুকু ভালবাসতে হবে আর যতটুকু গুনাহ বা ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম রয়েছে ততটুকু ঘৃণা করতে হবে।
➤ বি:দ্র:
কাফের-মুশরেকও পাপাচারীদের প্রতি রাগ, ঘৃণা বা দুশমনী পোষণ করার অর্থ এই নয় যে, তাদের সাথে কোন ধরণেরে যোগাযোগ রাখা যাবে না, তাদের সাথে কথা বলা যাবে না বা তাদেরকে মোটেই সাহায্য-সহযোগিতা করা যাবে না। বরং সঠিক কথা হল, দাওয়াতের স্বার্থে বা নিজের প্রয়োজন পূরনের উদ্দেশ্যে তাদের সাথে বাহ্যিক সম্পর্ক রাখা যাবে, চলাফেরা করা যাবে এবং তাদেরকে সাহায্য-সহযোগতিও করা যাবে। এভাবে সুসম্পর্ক রেখে তাকে দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে হবে। হতে পারে, এই সদাচারণ ও সাহায্য-সহযোগিতা তাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করবে, ইসলামের প্রতি তাদের বিদ্বেষ ও দুশমনী লাঘব করবে অথবা তদেরকে কুরআন-সুন্নাহর দিকে ফিরে আসতে উৎসাহিত করবে। আল্লাহু আলাম।
———————–
উত্তর প্রদানে: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
(লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সউদী আরব)
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।।