আহলে হাদীস নাম কী ইংরেজ কর্তৃক বরাদ্দকৃত এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ
৯৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক সিন্ধ বিজয়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে মুসলমানদের রাজত্ব শুরু হলেও তার পূর্বে অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী ব্যক্তিগতভাবে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচার করেছেন।তাদের মাধ্যমে অসংখ্য লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।কমপক্ষে ২৫ জন সাহাবী ও ৪০ এর অধিক তাবেয়ীর পদরেণুতে উপমহাদেশের মাটি ধন্য হয়েছে।আর তখন থেকেই আহলে হাদীসের পাদচারণা উপমহাদেশের বুকে।
এর প্রমাণসরূপ আমরা শুধুমাত্র প্রখ্যাত ভূ-পর্যটক শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল-মাক্বদেসী একটা উদ্ধৃতি নকল করছি।তিনি ৩৭৫ হিজরীতে ভারতের তৎকালীন ইসলামী রাজধানী সিন্ধুর মানসূরায় আসেন।মানসূরা (করাচী) সম্পর্কে তিনি বলেন:أكثرهم اصحاب الحديث
অর্থাৎ সেকানকার অধিকাংশ মুসলিম অধিবাসী আহলে হাদীস। তিনি আরো বলেন, ক্বাজী আবূ মুহাম্মাদ মানসূরী নামে সেখানে দাউদী মাযহাবের একজন ইমাম আছেন।তার লিখিত অনেক মূল্যবান কিতাবাদি রয়েছে।মুলতানের অধিবাসীরা শি’আ মতাবলম্বী। প্রত্যেক শহরে কিছু কিছুই হানাফী ফকীহ আছেন।এখানে মালেকী বা মু’তাযেলী কেউ নেই,হাম্বালীও নেই।(আহসানুত তাকাসীম ৪৮১,আহলে হাদীস কী ও কেন ২৮ এর উদ্ধৃতিতে)
এখানে বেশ কয়েকটা জিনিস প্রমাণিত হয়:
১) আহলে হাদীস শব্দ অন্যান্য মাযহাবের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে।যা প্রমাণ করে আহলে হাদীস স্বতন্ত্র এক মাসলাকের নাম।যার মাঝে জনসাধারণও শামিল।
২) আহলে হাদীস দ্বারা যে জনসাধারণ উদ্দেশ্য তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। কেননা একটি রাজধানীর অধিকাংশ মানুষ মুহাদ্দিস হওয়া অসম্ভব।
৩) ইংরেজদের বহুকাল পূর্বে উপমহাদেশে আহলে হাদীসের অস্তিত্ব ছিল।
৪) আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা দেয়নি। কারণ ৩৭৫ হিজরীতে তাদের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা ভারতীয় উপমহাদেশে।
অতএব প্রমাণিত হয়, ইংরেজদের বহুকাল পূর্ব থেকে ভারত উপমহাদেশে আহলে হাদীসের অস্তিত্ব ছিল এবং তারা আহলে হাদীস নামই তাদের পরিচয়ে ব্যবহার করতো। তাই একথা বলার কোনো সুযোগই নাই যে,আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা রাখে,উপমহাদেশে আহলে হাদীসের কোনো অস্তিত্বই ছিলনা ইংরেজদের পূর্বে।
কিন্তু আফসোস! একটি গোষ্ঠী আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও নিজেদের মাঝে জমিয়ে রাখা বিষ উদগীরণ করতে গিয়ে বলে আহলে হাদীস নাম ইংরেজরা দিয়েছে।ইতিপূর্বে এ নাম ছিলনা। তাদের এ দাবীর বাতুলতা প্রমাণের জন্য উপরে উল্লেখিত আল-মাক্বদেসীর বক্তব্যই যথেষ্ট।
তারা তাদের দাবীর পক্ষে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর একটি চিঠির উদ্ধৃতি প্রদান করে থাকে।আমরা উক্ত চিঠির সে অংশটুকু উল্লেখ করব, যা তারা তাদের দাবীর পক্ষে পেশ করে থাকে।
…..اس فرقہ کے حق میں استعمال لفظ وہابی سرکاری خط و کتابت میں موقوف کیا جاوے اور اھل نام سے مخاطب کیاجائے
সুতরাং এ দলের লোকজনের বেলায় এ শব্দের (ওয়াহাবী, প্রবন্ধকারের পক্ষ থেকে) ব্যবহারের উপর খুবই আপত্তি করণ এবং পূর্ণ সম্মান ও বিনয়ের সাথে সরকারের নিকট আবেদন করে যে, যেন সরকারীভাবে (হিতাকাঙ্খী ও নিমক হালালের প্রেক্ষিতে, বইয়ের অনুবাদকের পক্ষ থেকে) এ শব্দটি নিষিদ্ধ করে তার ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা করা হোক এবং তাদেরকে আহলে হাদীস নামে সম্বোধন করা হউক।………..এই দলের ব্যাপারে ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সরকারী চিঠিপত্রে বন্ধ করা হোক এবং আহলে হাদীস নামে সম্বোধন করা হোক (এই অনুবাদ হানাফী কিতাব ‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৩ থেকে নেয়া হয়েছে।)
হানাফী কিতাব ‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’তে স্যার সৈয়দ আহমাদ থেকে একটি বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে।তা নিম্নরূপ-
মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইন সরকারকে আবেদন করে যে,এই ফিরকাটি যারা প্রকৃতপক্ষে আহলে হাদীস, সরকার যেন তাদেরকে ওয়াহাবী নামে সম্বোধন না করে।মৌলভী মুহাম্মদ হোসাইনের প্রচেষ্টায় সরকার তা অনুমোদন করে।যেন আগামীতে সরকার লেখা-লেখিতে এই দলটিকে ওহাবী শব্দের স্থলে আহলে হাদীস নামে উল্লেখ করে।( ‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৪)
আমরা উপরে হানাফী কিতাবের উদ্ধৃতিতে দেখলাম আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ সরকারকে এমর্মে চিঠি লিখেননি যে, আপনারা গোটা দেশে এ হুকুম জারি করেন যে, আজ থেকে আমাদের ওয়াহাবী নামে ডাকা যাবেনা,আমাদেরকে আহলে হাদীস নামে ডাকতে হবে এবং আপনারা আমাদের নাম রাখুন ‘আহলে হাদীস’। শুধুমাত্র তিনি এমর্মে চিঠি লিখেন যে,যেন সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী লেখা না হয়।ওয়াহাবী শব্দের স্থানে যেন আহলে হাদীস ব্যবহার করা হয়।অতএব যারা প্রচার করে বেড়ায় ইংরেজরা আহলে হাদীস নাম দেয় তারা মূলত সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
ইংরেজ সরকার আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর উক্ত চিঠির উত্তরও তাকে দেয়।আমরা এখন সেই উত্তর পাঠকদের সামনে তুলে ধরব।কেননা সেই উত্তর এই মিথ্যাচারের অট্টালিকাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট করে দিবে আহলে হাদীস নাম ইংরেজ কর্তৃক দেয়া কোনো নাম নয়।প্রথম উত্তর হচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট-এর পক্ষ থেকে পাঞ্জাবের সেক্রেটারি বরাবর।
Dated 3rd December 1886
From the officiating Secretary to the government of India, Home Department,
To the Secretary of the Punjab.
In reply to your letter No 1044 of the 8th June last, I am directed to say that the Governor General in council issued expresses his concurrence with the views of sir Charles Aithison that the use of the term Wahhabi should be discontinued in official correspondence.
তারিখ ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৬
ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি ভারত সরকার, স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তর-এর পক্ষে থেকে
পাঞ্জাব সেক্রেটারি বরাবর।
আপনার চিঠি নাম্বার ১০৪৪, তারিখ ৮ জুন ১৮৮৬-এর জবাবে আমাকে বলতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে,গভর্নর জেনারেল কাউন্সিলের জারিতে স্যার চার্লস ইচিসন এর সাথে এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছে যে,আগামীতে সরকারী চিঠিপত্রে “ওয়াহাবী” নামের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
এবার দেখুন ২য় উত্তর যা আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহকে পাঠান হয়।
From U.M. Young, Secretary to the Government of Punjab
To Maulvi abu saeed Mohammad Hussain Editor of Ishaat ul sunnah,Lahore
In reply to your letter No 195 of the 12th May last, asking that the use of the expression Wahhabi in reference to the members of the community which you claim to represent may be prohibited in government order.
I am directed to forward the enclosed copy of a letter No 1738 of the 3rd from the officiating Secretary to the government of India in the Home Department,sanctioning discontinuance of the use of the term Wahabi in official correspondence.
I return the books received with your letter No 547 of the 21 September last, together with the original signed notices which you have been good enough to submit in your subsequent letters for the persual of the government.
ইউ.এম ইয়াং পাঞ্জাব সরকারের সেক্রেটারি-এর পক্ষ থেকে
মৌলভী আবু সাঈদ মোহাম্মাদ হুসাইন ইসহাত উল সুন্নাহ, লাহোর এর সম্পাদক বরাবর,
আপনার চিঠি নাম্বার ১৯৫, ১২ ই মে এর জবাবে,তাতে আপনি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সদস্যের জন্য ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন যার প্রতিনিধিত্ব আপনি করেন, সরকারী চিঠিপত্রে এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে পারে । জনাব লেফটেনেন্ট গভর্নমেন্ট-এর বিধিমত আপনার কাছে চিঠি নাম্বার ১৭৩৮ মোহরকৃত ৩য়-এর অনুলিপি পাঠাচ্ছি।যাতে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি অধ্যাদেশ জারি করেছে যে,সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী শব্দ যেন ব্যবহার না করা হয়।উক্ত চিঠির সাথে সেসব বইও ফেরত পাঠাচ্ছি যা আপনি গত ২১ সেপ্টেম্বর চিঠি নাম্বার ৫৪৭-এর সাথে নিরীক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এবং অরজিনাল সাক্ষরিত নোটিশও পাঠানো হল যেটি সরকারের দৃষ্টি অর্জনের জন্য পরবর্তি চিঠির সাথে আপনাকে জমা দিতে হয়েছে।
এই সব ইংরেজি চিঠি মুসলিম আহলে হাদীস গেজেট দিল্লী, ডিসেম্বর ১৯৯৩ থেকে গৃহীত। উক্ত গেজেট এসব ইংরেজি চিঠি ‘আখবারে ইংলিশম্যান কলকাতা, নাম্বার ৪৪, প্রকাশ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৭, থেকে নকল করে।(তারীখে আহলে হাদীস, সংকলক, ড.বাহাউদ্দীন ১/১২৪-১২৫)
ইংরেজ সরকারের উপরের প্রতিউত্তর চিঠি পাঠকগণ দেখলেন।তারা আহলে হাদীস নামকরণ করে- এ দাবী তো বহুত দূরের কথা।তারা উভয় চিঠিতে একবারের জন্য ‘আহলে হাদীস’ শব্দটি উল্লেখ করেনি।তারা শুধুমাত্র বলেছে আগামীতে আমরা আমাদের সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী লিখবো না।আর ইতিপূর্বে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর চিঠি ও স্যার সৈয়দ আহমাদের বক্তব্য দেখিছি যে,আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ শুধুমাত্র এমর্মে চিঠি দেন যেন সরকারী চিঠিপত্রে ওয়াহাবী না লিখা হয়।তিনি আবেদন করেননি যে,আমাদের আহলে হাদীস নামকরণ করা হোক। আহলে হাদীসকে ওয়াহাবী বলা ছিল সুস্পষ্ট অন্যায় ও বেইনসাফী।এর বিরুদ্ধে আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ আওয়াজ বুলন্দ করেন।তারই প্রেক্ষিতে তিনি সরকারকে চিঠি দেন যেন ওয়াহাবী বাদ দিয়ে আসল নাম আহলে হাদীস সরকারী চিঠিপত্রে লেখা হয়।চিঠিতে ছিলনা যে,আমরা ওয়াহাবী আর ওয়াহাবী নাম আমাদের ভালো লাগেনা। তাই আমাদের নতুন নাম দেয়া হোক বা আহলে হাদীস নাম দেয়া হোক।তারপরও যদি মেনে নেওয়া হয় যে, আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী আহলে হাদীস নামকরণের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন, তবুও প্রমাণ হয়না যে,ইংরেজরা আহলে হাদীস নামকরণ করে।কেননা তারা আহলে হাদীস শব্দটি একটি বারের জন্যও উল্লেখ করেনি।এবার পাঠকগণের হাতে ছেড়ে দিলাম,আপনারা বলুন! ইংরেজরা কি আহলে হাদীস নামকরণ করেছে?
আরো কথা হচ্ছে, এই চিঠি দেওয়ার বহু পূর্ব থেকেই ভারতবর্ষে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার হয়ে আসছিল।যারা এই নামে অবহিত হতেন তারা ইংরেজ সরকারকে চিঠি দেয় তাদের মূল নাম ব্যবহার করার জন্য।কেননা ওয়াহাবী তাদের আসল নাম নয়।তাই তারা এই নতুন নাম নিজেদের জন্য মেনে নিতে পারেননি। তারা ফিরিয়ে পেতে চেয়েছিলেন তাদের মূল সম্পত্তি তথা আহলে হাদীস নাম।
উক্ত চিঠি ১৮৮৬ সালে দেয়া হয়।যিনি (আল্লামাহ বাটালাভী) উক্ত চিঠি দেন স্বয়ং তিনি এর পূর্ব থেকে নিজেদের আহলে হাদীস বলতেন এবং এই নাম পছন্দ করতেন।উক্ত চিঠির পূর্বেই তিনি তার ‘ইশা’আতে সুন্নাহ’ পত্রিকায় নিজের এবং নিজেদের দলের জন্য আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করতেন। আমরা ১৮৮৬ সালের পূর্বে তার ‘ইশা’আতে সুন্নাহ’ পত্রিকা থেকে আহলে হাদীস নাম ব্যবহারের প্রমাণ পেশ করব।স্বয়ং আল্লামাহ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন-
মাওলানা সাইয়িদ নাযীর হুসাইন মুহাদ্দিস মুলকে হিন্দুস্থানে এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ইলমে হাদীস, ছাত্র ও অনুসারীদের সংখ্যাধিক্যতা এবং জনসাধারণের মাঝে মান্যবরতার দিক থেকে অদ্বিতীয়। সম্মানিত ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব এই আহলে হাদীস জামা’আতে আরো রয়েছে। যাদের লেখনীর মাধ্যমে ইলমের প্রচার-প্রসার, প্রবন্ধের মাধ্যমে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা এবং বিদ’আদ ও গর্হিত কাজ দূর করার মাধ্যমে দ্বীনের সংস্কার হয়েছে।এই চারটি গুন বিশেষ করে চতুর্থ গুনের ব্যাপারে তার সমতুল্য আমি কাউকে পাইনি।এই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা বলতে পারি এবং সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে,সম্মানিত মাওলানাকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা মানে আহলে হাদীস জামা’আতের সকলকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন করা।আর তাকে অসম্মান করা মানে আহলে হাদীস জামা’আতকে অসম্মান করা। (ইশা’আতে সুন্নাহ, খণ্ড ৬, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ)।
আহলে হাদীসের ব্যাপারে কিছু লোক কিছু অপবাদ আরোপ করলে তিনি এক ইশতিহার প্রদান করেন। তা নিম্নরূপ-
এই খাকসার ইশতিহারের মাধ্যমে বর্তমানে প্রচলিত এক হাযার রুপী সে ব্যক্তির জন্য পুরস্কার দেওয়ার অঙ্গীকার করছি, যে আহলে হাদীসের উপর আরোপিত অভিযোগ ও অপবাদ তাদের মামুলী ও গ্রহণযোগ্য কিতাব থেকে (পূর্ব, পশ্চিম, আগের ও পরের লোকদের নিকট গ্রহণযোগ্য) প্রমাণ করবে।অথবা সে যে আহলে হাদীসের অনুসারী তা এমন উসূল ও কানূন থেকে প্রমাণ করবে যার ব্যাপারে অবহিত করেছেন হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ,মীযানে শা’রানী বা ইকাফে মুল্লা হায়াত সিন্ধী। অথবা ইশা’আতে সুন্নাহ সংখ্যা নাম্বার ৬, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৮৪ তে বর্ণীত হয়েছে, তা প্রমাণ করবে।
ইশতিহার দাতা: আবূ সাঈদ মুহাম্মাদ হুসাইন লাহোরী।(ইশা’আতে সুন্নাহ, সংখ্যা নাম্বার ৫,খণ্ড ৬,মে ১৮৮৩)
পাঠকগণ লক্ষ্য করলেন তিনি ১৮৮৩ সালে আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করেছেন।আর তিনি ইংরেজদের চিঠি দেন ১৮৮৬ সালে।তার মানে চিঠি দেওয়ার ৩ বছর পূর্ব থেকেই তিনি আহলে হাদীস নাম ব্যবহার করে আসতেন।তাহলে এই আহলে হাদীস নাম কীভাবে ইংরেজদের দেয়া নাম হতে পারে?
আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহর চিঠি দেওয়ার কারণ:
আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ বেশ কিছু কারণকে সামনে রেখে উক্ত চিঠি প্রদান করেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:
১) তৎকালীন সময়ে ইংরেজ সরকার, বিদ’আত পন্থীসহ আহলে হাদীসের দুশমনরা আহলে হাদীসকে সমাজের চোখে কলুষিত করার জন্য ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার শুরু করে।যার সবচে’ বড় প্রমাণ হচ্ছে তৎকালীন সময়ে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার কর্তৃক লিখিত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ কিতাব।আর ওয়াহাবী শব্দ সে সময়ে গালি, বিদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক অর্থে ব্যবহার হত।তাই তিনি মেনে নিতেন পারেননি এরুপ ঘৃণিত শব্দ আহলে হাদীসের ব্যাপারে ব্যবহার হোক।যেহেতু ইংরেজ সরকার ওয়াহাবী শব্দের প্রচলন বেশি ঘটায়, তাই তিনি তাদের কাছে এ শব্দ বন্ধের জন্য চিঠি দেন।স্বয়ং আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ একথা চিঠিতে উল্লেখ করে বলেন: ওয়াহাবী শব্দ যা সাধারণত বিদ্রোহী এবং নিমক হারামের অর্থে ব্যবহার হয় এবং যে শব্দের ব্যবহার হিন্দুস্থানের মুসলমানদের ঐ দলটির ব্যাপারে ব্যবহার হয় যাদেরকে আহলে হাদীস বলা হয়।(‘তাকলীদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’ মূল লেখক, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাসউদ আহমাদ, ভাষান্তর, মাওলানা হারুন ইযহার, প্রকাশক, মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী, প্রকাশকাল, ১৫ এপ্রিল ২০১১, পৃষ্ঠা ৬৪)
২) ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার সে সময়ে ব্যাপকহারে শুরু হয়।এমনকি মূল নাম আহলে হাদীস হারিয়ে যেতে বসেছিল।তিনি ভাবলেন যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তবে আহলে হাদীস নামের হয়তো একদিন অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।এর পিছনে যেহেতু ওয়াহাবী শব্দের প্রচলন বেশি দায়ী ছিল, তাই তিনি ওয়াহাবী শব্দের ব্যবহার বন্ধ করতে চান।
৩) সবচে’ বড় কারণ হল তিনি এর মাধ্যমে আহলে হাদীস জনগণকে ইংরেজদের নির্যাতন, জেল,মামলা, হত্যা ইত্যাদির মত ভয়ানক অবস্থা থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। কেননা ওয়াহাবী শব্দ আহলে হাদীসদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হত।আর ওয়াহাবী মানেই ইংরেজ বিরোধী। অতএব তাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা কর,তাদেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলাও,কালাপানিতে নির্বাসন দাও ইত্যাদি। এর সত্যতা আমরা অনেক ইতিহাসবিদদের কিতাবাদি থেকে পাই।যা উল্লেখ করার স্থান এটা নয়।প্রয়োজনে অন্য কোনো দিন উল্লেখ করা যাবে।এর প্রমাণসরূপ বলতে পারি ১৮৬৫ সালে ইংরেজরা অন্যায়ভাবে আহলে হাদীসের বিরুদ্ধে পাঁচ পাঁচটি মামলা দায়ের করে।এবং এই মামলার কারণে অনেক আহলে হাদীস পরিবার সর্বশান্ত হয় এবং বিভিন্ন প্রকার পাশবিক নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।এই তৃতীয় কারণ সম্পর্কে স্বয়ং আল্লামাহ হুসাইন আহমাদ বাটালাভী রহিমাহুল্লাহ এভাবে বলেছেন:একজনের কর্মকাণ্ডের কারণে দলের সকলকে খারাপ ভাবা বিবেক ও ইনসাফেপূর্ণ কথা নয়।
উক্ত দ্বিতীয় কারণকে ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখলে প্রমাণিত হয় যে,সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রকে যারা আহলে হাদীসের কাধে চাপাচ্ছে তারাও ভালভাবে জানে যে, সেসব বিদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারীদের কারণে গোটা আহলে হাদীসকে খারাপ বলে চিহ্নিত করা ইনসাফ বিরোধী।(ইশা’আতে সুন্নাহ, খণ্ড ৮,১৮৮৬; তারীখে আহলে হাদীস, পৃষ্ঠা ১/১১৬) এর আগে তিনি ব্রিটিনে বিদ্রোহমূলক ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা তুলে ধরে বলেন: এসব লোকদের বিদ্রোহের কারণে কেউ তো গোটা খ্রিষ্টান জাতিকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেনা।
সার্বিক ক্রিতজ্ঞতাঃ আব্দুল্লাহ মাহমুদ