ইমাম আলবানী (রহঃ) কি ফক্বীহ নন?
বাংলাদেশের জনৈক আলেম তার বক্তব্যে বলেছেন, ইমাম অালবানী শুধু মুহাদ্দিছ তিনি ফক্বীহ নন। তার কথার সারমর্মে বুঝা যায় আলবানী (রহঃ) কোন হাদীছকে ছহীহ বা যঈফ বললে সেটা গ্রহণ করা যাবে বাট তিনি কোন ফৎওয়া দিলে সেটা গ্রহণ করা হবেনা।
প্রথমত আমি বলতে চাই এই মন্তব্যটি শুধু আলবানী (রহঃ)-এর ক্ষেত্রে নয় বরং যুগে যুগে মুহাদ্দিছগণের শানে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। একদল মানুষের দাবী অনুযায়ী মুহাদ্দিছগণ ফক্বীহ নন। তাদের এই কথার জবাবে আমি ‘আমরা হাদীছ মানতে বাধ্য’ বইয়ে বলেছি, যথা-
“মুহাদ্দিছগণ ফিক্বহী জ্ঞান রাখেন না এই জাতীয় মন্তব্য ভিত্তিহীন। আমরা জানি পৃথিবী বিখ্যাত ফকীহ হচ্ছেন ৪ জন। ইমাম নুমান বিন ছাবিত আবু হানীফা (রহঃ) (মৃ.১৫০ হি.)। ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস শাফেয়ী (রহঃ) (মৃ.২০৪হি.)। ইমাম মালিক বিন আনাস (রহঃ) (মৃ.১৭৯হি.)। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) (মৃ.২৪১হি.)।
অত্র ৪ জন বিখ্যাত মুজতাহিদ ফক্বীহের মধ্যে তিন জনই নিজ নিজ যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ হিসেবে পরিচিত। আজও তাদের পরিচিতি যতটা না তাদের ফিক্বহের জন্য তার চেয়ে বেশী তাদের হাদীছের খিদমাতের জন্য। তারাই জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করেন যে, মুহাদ্দিছগণ ফকীহ। মুহাদ্দিছগণের সম্পর্কে বিখ্যাত হানাফী আলেম আল্লামা আব্দুল হাই লাক্ষৌভী (রহঃ)-এর একটি মন্তব্যই যথেষ্ট। তিনি বলেন,
ومن نظر بنظر الإنصاف وغاص في بحار الفقه والأصول، متجنباً عن الإعتساف، يعلم علما يقيناً أن أكثر المسائل الفرعية والأصلية التي اختلف العلماء فيها، فمذهب المحدثين فيها أقوى من مذاهب غيرهم، وإني كلما أسير في شعب الاختلاف أجد قول المحدثين فيه قريبا من الإنصاف فلله دّرُّهُم، كيف لا وهم ورثة النبي حقاً ونُوَّاب شرعه صدقاً
আর যে ব্যক্তি গোড়ামী থেকে দূরে থেকে ইনসাফের দৃষ্টিতে দেখবে এবং ফিকাহ ও উসূলে ফিকাহের সাগরে ডুব দিবে সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারবে, নিশ্চয় শাখাগত ও মৌলিক যে সমস্ত মাসালায় ওলামায়ে কেরাম ইখতিলাফ করেছেন তাতে অন্যদের তুলনায় মুহাদ্দিছগণের মাযহাবই বেশী মযবূত। আর আমি যতবার মতভেদপূর্ণ মাসালাগুলো গবেষণা করেছি ততবার মুহাদ্দিছগণের মন্তব্যকে ইনসাফের সবচেয়ে নিকটে পেয়েছি। তারা কতইনা মহান! আর কেনইবা হবেনা তারাই তো মুহাম্মদ (ছাঃ)-এর প্রকৃত উত্তরসূরী এবং তার শরীয়তের সত্যিকার প্রতিনিধিত্বকারী। (ইমামুুল কালাম,পৃ.২১৬)” (আমরা হাদীছ মানতে বাধ্য, পৃ.৫৫)
এছাড়া ‘হাদীছ ও সুন্নাতের মধ্যে পার্থক্যঃ হাদীছ অস্বীকারেরর নতুন চোরাগলি ”বক্তব্যে বলেছিলাম,
ইমাম ইবন খালদুন তার মুকাদ্দামায় (১/৫৬৪) বলেছেন,
وانقسم الفقه فيهم إلى طريقتين: طريقة أهل الرّأي والقياس وهم أهل العراق وطريقة أهل الحديث وهم أهل الحجاز
তথা ফিক্বহ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আহলুর রায়ের পদ্ধতি ও আহলুল হাদীছের পদ্ধতি।
তিনি এখানে আহলুল হাদীছ বা মুহাদ্দিছগণের ফিক্বহকে স্বীকার করেছেন। বক্তব্যটির লিংক- https://www.youtube.com/watch?v=wc5… ।
মুহাদ্দিছগণের ফিক্বহ বেশী মযবূতঃ
মুহাদ্দিছগণ যে ফক্বীহ এটা প্রমাণ করার পর আমি বলতে চাই, মুহাদ্দিছগণের ফিক্বহটাই বেশী মযবূত। যেমন আমরা দেখেছি আব্দুল হাই (রহঃ)-এর মন্তব্যে। কেননা অনেক সময় এমন ফক্বীহ যার হাদীছের জ্ঞান তেমন নাই সে হয়তো নিজের বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে একটা ফৎওয়া দিল। পরবর্তীতে দেখা গেল সেই বিষয়ে সরাসরি রাসূল (ছাঃ) থেকে বিপরীত মন্তব্য রয়েছে। অপর পক্ষে মুহাদ্দিছ এই ঝুকি থেকে মুক্ত। তেমনি কোন ফক্বীহ যার হাদীছের জ্ঞান তেমন নাই সে হয়তো এমন একটি হাদীছ দিয়ে কোন ফৎওয়া দিল যে হাদীছটি হয়তো দুর্বল বা জাল। অপর পক্ষে মুহাদ্দিছ এই ঝুকি থেকে মুক্ত। এই জন্য মুহাদ্দিছের ফিক্বহ সর্বদা বেশী মযবূত। মুহাদ্দিছগণের ফিক্বহ যে সুক্ষ্মও হয়ে থাকে তা বুঝতে চাইলে ছহীহ বুখারী পড়তে হবে। ইমাম বুখারী তার ছহীহ বুখারীতে যেভাবে অধ্যায় রচনা করেছেন এবং হাদীছ থেকে ইস্তিদলাল করেছেন তা বুঝতে ওলামারা হিমশিম খান।
একটি ভূল ধারণাঃ আমাদের দেশের ওলামায়ে কেরামের মধ্যে অন্যতম একটি ভুল ধারণা হচ্ছে তারা হাদীছের বর্ণনাকারী এবং মুহাদ্দিছের মধ্যে পার্থক্য করেননা। মনে করেন হাদীছের প্রত্যেক বর্ণনাকারী মুহাদ্দিছ। অসম্ভব! এই ভূলের কারণেই তারা বলে ফেলে মুহাদ্দিছগণ হচ্ছেন ফারমাসিস্ট। মনে রাখতে হবে, যে ব্যক্তি একটি হাদীছ মুখস্থ করেছে ও বর্ণনা করেছে সেও হাদীছের রাবী তেমনি ইমাম মালেক (রহঃ)ও হাদীছের রাবী। কিন্তু একটি হাদীছ বর্ণনাকারী কোন সময় মুহাদ্দিছ নয় আর ইমাম মালেক নিঃসন্দেহে মুহাদ্দিছ। শুধু তাই নয় যুগে যুগে মুহাদ্দিছ হওয়ার যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেখানে শুধু হাদীছ মুখস্থ করলেই কেউ মুহাদ্দিছ হয়ে যাবে এমনটি বলা হয়নি। বরং হাদীছের সানাদ ও টেক্সট সব বিষয়ে যে জ্ঞান রাখে তাকে মুহাদ্দিছ বলা হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক যে মুহাদ্দিছ হবে সে নিশ্চিত ফক্বীহ।
ইমাম আমাশের মন্তব্যের জবাবঃ ইমাম আমাশের পূর্ণ নাম হচ্ছে সুলায়মান বিন মিহরান অাল-আমাশ। তার বিষয়ে সুফিয়ান বিন উয়ায়না বলেন
كَانَ الأَعْمَشُ أَقْرَأَهُم لِكِتَابِ اللهِ، وَأَحْفَظَهُم لِلْحَدِيْثِ، وَأَعْلَمَهُم بِالفَرَائِضِ
তথা আমাশ একাধারে কুরআনের বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী, হাদীছের সবচেয়ে হাফিয, এবং ফারায়েয বিষয়ে সবচেয়ে জ্ঞানী। (সিয়ারু আলামিন নুবালা, ৬/২২৮ )
অামাদের মনে রাখতে হবে ইসলামে যত মাসালা-মাসায়েল রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন মাসায়েল হচ্ছে ফারায়েয। মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীগণের মাঝে সম্পদ বন্টন সংক্রান্ত জ্ঞানকে বলা হয় ফারায়েয। যে ফারায়েযের জ্ঞান রাখবে সে ফক্বীহ নয় এটা কল্পনা করা অসম্ভব। শুধু তাই নয় ইমাম আমাশ হচ্ছেন ইবরাহীম নাখয়ী (রহঃ)-এর বিখ্যাত ছাত্র। অর ইবরাহীম নাখয়ী একজন বিখ্যাত মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ। শুধু তাই নয় হানাফী ভাইগণের নিকট সানাদের যে সিলসিলার রাবীগণ খুবই প্রিয় এবং ফক্বীহ হিসেবে স্বীকৃত সেই সিলসিলাটি হচ্ছে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে আলকামা রহঃ তার থেকে ইবরাহীম নাখয়ী রহ তার থেকে হাম্মাদ তার থেকে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) । এই ফিক্বহী সিলসিলার অন্যতম একজন হচ্ছেন আমাশ (রহঃ) । এমনকি পৃথিবীতে সর্ব বিশুদ্ধ সানাদ হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) থেকে আলকামা রহঃ তার থেকে ইবরাহীম নাখয়ী রহ তার থেকে আমাশ রহঃ। সুতরাং ইমাম আমাশ রহঃ নিঃসন্দেহে একজন ফক্বীহ। তারপরেও কেন তিনি ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-কে বললেন ‘আপনারা ডাক্তার আর আমরা হচ্ছি ফারমাসিস্ট’। এটা মূলত ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর সামনে তার বিনয় বৈ কিছুই নয়। তার এই বিনয়কে পুঁজি বানিয়ে দুনিয়ার সকল মুহাদ্দিছকে গইর ফক্বীহ ছাবিত করা। ধৃষ্টতা। বোকামী। তাহলে দুনিয়ার তিনটি মাযহাবই ফিক্বহ থেকে খারিজ হয়ে যাবে। যা আমরা আগেই প্রমাণ করেছি।
ইমাম আলবানী নিঃসন্দেহে ফক্বীহঃ
এবার আসি ইমাম নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ)-এর বিষয়ে – প্রথমত আমরা দেখব তিনি কি ফিক্বহী বিষয়ে কোন গ্রন্থ লিপিবদ্ধ করেছেন? না শুধু হাদীছের তাহক্বীক্ব বিষয়ে গ্রন্থ লিখেছেন।
ক. সিফাতু ছলাতিন নাবী – ছালাত নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বই এটি।
খ. আহকামুল জানায়েয – জানাযার হুকুম-আহকাম নিয়ে অসাধারণ একটি বই।
গ. আদাবুয যিফাফ – বাসর রাতের হুকুম-আহকাম নিয়ে লিখিত গ্রন্থ।
ঘ. তামামুল মিন্নাহ – ফিক্বহুস সুন্নাহ-এর উপর লিখিত অসাধারণ একটি গ্রন্থ।
এই বইগুলো স্পষ্ট প্রমাণ বহন করে ইমাম আলবানী (রহঃ)-এর ফিক্বহী জ্ঞান ছিল। শুধু তাই নয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ সিলসিলা ছহীহা-এর পূর্ণ নাম কি জানেন ?
سلسلة الأحاديث الصحيحة وشيء من فقهها وفوائدها
তথাঃ ছহীহ হাদীছের সিলসিলা ও সেই হাদীছগুলোর ফিক্বহ ও উপকারিতা। তার এই নাম প্রমাণ করে তিনি ফক্বীহ ছিলেন।
এইবার আসি ওলামায়ে কেরাম তার বিষয়ে কি মন্তব্য করেছেন?
শায়খ সলিহ আল মুনাজ্জিদ স্পষ্টভাষায় বলেছেন,
الشيخ الألباني رحمه الله محدث كبير وفقيه مجتهد
তথা আলবানী রহঃ অনেক বড় মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ মুজতাহিদ। দেখুন!https://islamqa.info/ar/113687
শায়খ সলেহ আল উসাইমীন (রহঃ) বলেছেন
أنه ذو علم جم في الحديث رواية ودراية .
তথা তিনি হাদীছ শাস্ত্রে সানাদগত ও মাতানগত উভয় দিকে থেকে অনেক জ্ঞানের অধিকারী। (রাদউল জানী, ত্বরেক আওজুল্লাহ-১ম অধ্যায়)
এখানে স্পষ্টভাবে শায়খ সলেহ আল উসাইমীন (রহঃ) বলেছেন হাদীছের সানাদ শুধু নয় বরং মূল টেক্সট বিষয়েও শায়খের জ্ঞান অনেক গভীর।
সুতরাং আলবানী (রহঃ) নিঃসন্দেহে একজন মুজতাহিদ ফক্বীহ । ওয়াল্লাহু আলামু মিন্না।
পরিশেষে বলতে চাই, ইমাম আলবানী যে ফক্বীহ নন এই মন্তব্য করতে আগে তার মত মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ হওয়া লাগবে। যিনি ফক্বীহ মুজতাহিদ নন আমার মনে হয় তার এই ধরণের মন্তব্য করা উচিৎ নয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সুমতি দান করুন!!
লেখকঃ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রাযযাক।
ছাত্রঃ মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা, সৌদিআরব।।
ছাত্রঃ মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মদিনা, সৌদিআরব।।