মূলঃ যুবায়ের আলী যাঈ
ভাষান্তরঃ আবূ মুবাশশির আহমাদ বিন আব্দুত তাওয়াব আনসারী (আহমাদুল্লাহ সৈয়দপুরী)
সম্পাদনাঃ আবু হিশাম মুহাম্মাদ ফুয়াদ
ভূমিকা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। যিনি সমস্ত জগতের প্রতিপালক। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁঁর বিশ্বস্ত রাসূলের উপর। অতঃপর-
এই সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ প্রবন্ধে কুরবানীর কতিপয় আহকাম ও মাসায়েল দলীলসহ পেশ করা হল।-
কুরবানী করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ আজকের দিনে (ঈদুল আযহা) আমরা সর্বপ্রথম সালাত পড়ব। অতঃপর প্রত্যাবর্তন করে কুরবানী করব (ইনশাআল্লাহ)। যে এমনটি করল সে আমার সুন্নাত পালন করল। আর যে (সালাতের আগে) যবাই করল তার কুরবানী হল না [১]
কতিপয় আলেমের নিকটে কুরবানী ওয়াজিব। কিন্তু এর পক্ষে তাদের নিকটে কোন স্পষ্ট দলীল নেই। পক্ষান্তরে সহীহ মুসলিমের হাদীস [২] দ্বারা কুরবানীর ওয়াজিব না হওয়া প্রমাণিত হয়। উপরন্তু সাইয়েদুনা আবূ বকর ও সাইয়েদুনা ওমর রাযিআল্লাহু আনহুমার নিকটে কুরবানী ওয়াজিব নয় [৩]
ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘কুরবানী করা সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। কিন্তু যে ব্যক্তি এর ক্ষমতা রাখে, তার কুরবানীকে বর্জন করা আমার নিকট অপছন্দনীয়।’ [৪]
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘কুরবানী করা সুন্নাত (এবং) আমি একে বর্জন করা পছন্দ করি না’ [৫]
প্রমাণিত হল যে, ঈদুল আযহায় ঈদের সালাতের পর কুরবানী করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ। আর শারঈ কারণ ব্যতীত কুরবানী না করা অপছন্দনীয় কাজ।
কতিপয় হাদীস অস্বীকারকারী অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ আক্বায়েদ এবং মাসায়েলকে অস্বীকারের সাথে কুরবানীর সুন্নাত হওয়াকেও অস্বীকার করেছেন। অথচ কুরবানী করার প্রমাণ সহীহ, মুতাওয়াতির হাদীসসমূহ বরং কুরআন মাজীদেও বিদ্যমান আছে [৬]
কুরবানীর পারিভাষিক অর্থ
ঈদুল আযহার সলাতের পর প্রথম দিন অথবা কুরবানীর দিনগুলিতে গৃহপালিত জন্তুর (যেমন বকরী, ভেড়া, গাভী, উট) মধ্য হতে কোন পশুকে শারঈ পন্থায় উৎসর্গ এবং নৈকট্য অর্জন করার লক্ষ্যে যবাই করাকে কুরবানী বলা হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্য : শহর হোক বা গ্রাম হোক, ঈদের ছলাতের পূর্বে কুরবানী করা জায়েয নেই।
কুরবানীদাতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্তসমূহ
(১) কুরবানী দাতাকে সহীহ আক্বীদাসম্পন্ন মুসলিম, কিতাব ও সুন্নাতের আনুগত্যকারী হওয়া, শিরক ও কুফর, বিদআতসমূহ হতে পাক হওয়া যরূরী। আর যার আক্বীদা নষ্ট, তার কোন আমল কবুলযোগ্য নয়। কুরআন, হাদীস ও ইজমার প্রতি পর্যবেক্ষণ করতঃ প্রতিটি মুহুর্তে স্বীয় ঈমান ও আমলের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
(২) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন তোমরা যুল হজ্জ মাসের চাঁদ দেখ এবং তোমাদের মধ্য হতে কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা কর; তখন তাকে স্বীয় চুল, নখ কাটা হতে বিরত থাকতে হবে’ [৭]।
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, কুরবানী দাতাকে যুল হজ্জের শুরু হতে কুরবানী করা পর্যন্ত নিজের চুল ও নখ কাটানো উচিৎ নয়।
যদি কারো নখ ভেঙ্গে যায় অথবা এমন খারাপ হয়ে যায় যে, নখ তুলে ফেলা/কাটা যরূরী হয়ে পড়ে; তাহলে এমন করা জায়েয। যেমনটি ইজমা দ্বারা প্রমাণিত আছে।
(৩) একটি হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করল, যদি আমি স্রেফ মাদী (দুধ দেয় এমন পশু) কুরবানী করার জন্য পাই তাহলে আমি কি সেটি কুরবানী করব?
তিনি বললেন, ‘না। কিন্তু তুমি নখ, চুল কেটে ফেলবে, গোঁফ ছাঁটবে এবং লজ্জাস্থানের চুল মুন্ডিয়ে ফেলবে। তাহলে আল্লাহর কাছে এটি সম্পূর্ণ কুরবানী হিসাবে গণ্য হয়ে যাবে’ [৮]
এই হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, যে ব্যক্তি কুরবানীর ক্ষমতা রাখে না, সে যদি প্রথম যুলহজ হতে শুরু করে ঈদের সলাত পর্যন্ত চুল না কাটায় এবং নখ না কাটে তবে সে কুরবানীর পুরো নেকী পাবে। সুবহানাল্লাহ।
কুরবানীর উদ্দেশ্য
কুরবানীর উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলাকে রাযী করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পুত-পবিত্র বরকতময় সুন্নাতের উপর একনিষ্ঠ নিয়াত দ্বারা আমল করা। আর এর অনেক বড় সওয়াব মিলবে ইনশাআল্লাহ।
কুরবানীর পশুর শর্তসমূহ
কোন প্রকারের পশুকে কুরবানী করতে হবে এবং তার কি কি শর্তসমূহ আছে তা বিভিন্ন উক্তি এবং ক্রমিকের মধ্যে এর বিস্তারিত আলোচনা পেশ করা হল-
(১) স্রেফ মুসিন্নাহ অর্থাৎ দাঁতবিশিষ্ট পশুই কুরবানী করা জায়েয। আর যদি ‘সংকির্ণতার’ কারণে দাঁত বিশিষ্ট পশু পাওয়া সম্ভব না হয় তবে এক বছর বয়স্ক দুম্বা কুরবানী করা জায়েয [৯]
‘সংকির্ণতা’ দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, হাট-বাজারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা এবং অনুসন্ধানের পরও দাঁতবিশিষ্ট পশু পেতে সক্ষম না হওয়া।
(২) হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে যে, চার (প্রকারের) পশু কুরবানী করা জায়েয নয়- (১) স্পষ্ট কানা। (২) স্পষ্ট অসুস্থ। (৩) স্পষ্ট খোঁড়া (৪) আর খুবই দুর্বল পশু যা হাড্ডিসার [১০]
(৩) সাইয়েদুনা আলী রাযিআল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিং কাটা পশু কুরবানী করতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এমন পশু যার অর্ধেক শিং বা ততোধিক ভেঙ্গে গিয়েছে’ [১১]
সাইয়েদুনা আলী রাযিআল্লাহু আনহু থেকে আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে (কুরবানীর পশুর মধ্যে) চোখ এবং কান দেখার হুকুম দিয়েছেন [১২]
এর উপর ইজমা আছে যে, অন্ধ পশু কুরবানী করা জায়েয নেই [১৩]
ইমাম খাত্তাবী রহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৩৮৮ হি.) বলেছেন, ‘এই হাদীসের (যেটি ২ নং ক্রমিকে গত হয়েছে) মধ্যে এই দলীল আছে যে, কুরবানীর পশুর মাঝে থাকা সাধারণ ত্রুটি ক্ষমাযোগ্য’ [১৪]
উবায়েদ বিন ফায়রূয (তাবেঈ) সাইয়েদুনা বারা বিন আযেব রাযিআল্লাহু আনহুকে (সাহাবী) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি এমন পশুও অপছন্দ করি যার দাঁতের মধ্যে ত্রুটি থাকে। তিনি বললেন, যা তুমি অপছন্দ কর তা বর্জন কর কিন্তু অন্যের জন্য সেটি হারাম করবে না’ [১৫]
বিশেষ দ্রষ্টব্য : যদি কোন পশুর শিং-এর উপর ঘর্ষণ জনিত সাধারণ ত্রুটি হয়ে থাকে অথবা শিং-এর উপরের আবরণটি ভেঙ্গে যায় তাহলে ইমাম সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব রহিমাহুল্লাহর উপরোল্লিখিত বর্ণনার আলোকে অত্র পশুর কুরবানী করা জায়েয।
কুরবানীর চামড়া
কুরবানীর চামড়া মিসকীন লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিবেন। যেমনটি সাইয়েদুনা আলী রাযিআল্লাহু আনহুর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত আছে [১৬]
যবাইকারী অথবা কশাইকে কুরবানীর চামড়া হতে মজুরী প্রদান করা জায়েয নয়। অনুরূপভাবে মজুরী হিসাবে কুরবানীর গোশত প্রদান করাও জায়েয নেই, বরং হারাম।
গোশত বন্টন
কুরবানীর সকল গোশত স্বয়ং ভক্ষণ করা বা সংরক্ষণ করা জায়েয। আর গোশতের তিনটি ভাগ করে একটি ভাগ নিজের জন্য, একটি গরীব-মিসকীন লোকদের জন্য এবং একটি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধদের জন্য নির্ধারিত করাও জায়েয। বরং এটি উত্তম [১৭]
কুরবানীর অংশ ও শরীকানা
বকরী ও দুম্বা-ভেড়ার শুধুমাত্র একটি ভাগ হয়ে থাকে। কিন্তু গাভী-ষাড়, উট-উটনীর মধ্যে সাতটি ভাগ সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। আর একটি হাসান রেওয়ায়াত দ্বারা উট-উটনীর মধ্যে দশ ভাগেরও প্রমাণ আছে [১৮]
সতর্কীকরণ : শুধু সহীহ আক্বীদা সম্পন্ন মুসলমানদের সাথে মিলে সাত অথবা দশ ভাগের মধ্যে শরীক হতে পারে। কিন্তু বিদআতপন্থী, গোমরাহ, ভ্রান্ত-ভ্রষ্টকারী লোকদের সাথে মিলে কখনোই কুরবানী করা উচিৎ নয়। আর এমন গোমরাহ লোকদের কোন আমলের কোনরূপ মূল্যও নেই। উল্টো এমন লোকদের সকল আমল ‘বিক্ষিপ্ত ধুলার ন্যায়’ বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হবে। ইনশাআল্লাহ।
পাদটীকা
[১] বুখারী হাদিস- ৫৫৪৫ ‘কুরবানীর সুন্নাত’ অনুচ্ছেদ
[২] সহীহ মুসলিম হাদিস- ১৯৭৭, দারুস সালামের ক্রমিক অনুসারে হাদীস- ৫১১৯
[৩] দেখুন মারিফাতুস সুনান ওয়াল আছার ৭/১৯৮, এর সনদ হাসান
[৪] মুওয়াত্তা ইমাম মালেক ২/৪৮৭
[৫] কিতাবুল উম্ম ১/২২১
[৬] যেমন দেখুন : সূরা আস-সফ্ফাত, আয়াত ১০৭; সূরা আল-হাজ্জ, আয়াত ৩৪; সূরা আল-আনআম, আয়াত ১৬২
[৭] সহীহ মুসলিম হা/১৯৭৭
[৮] সুনানে আবী দাঊদ হা/২৭৮৯, সনদ হাসান
[৯] দেখুন : সহীহ মুসলিম হা/১৯৬৩
[১০] দেখুন : সুনানে আবী দাঊদ হা/২৮০২, সনদ সহীহ
[১১] সুনানে তিরমিযী হা/১৫০৪, তিনি বলেছেন, হাদীসটি হাসান সহীহ
[১২] সুনানে তিরমিযী হা/১৫০৩, তিনি বলেছেন, হাসান সহীহ
[১৩] আল-মাজমূ শারহুল মুহায্যাব ৮/৪০৪
[১৪] মাআলিমুস সুনান ২/১৯৯
[১৫] সুনানে আবী দাঊদ হা/২৮০৩, সনদ সহীহ
[১৬] সহীহ মুসলিম হা/১৩১৭
[১৭] দেখুন : সূরা হাজ্জ, আয়াত ২৮, ৩৬
[১৮] দলীলের জন্য দেখুন : সহীহ মুসলিম হাদীস-১৩১৮; সুনানে তিরমিযী হাদীস-১৫০১, তিনি বলেছেন, ‘হাসান গরীব’
Source: www.darhadith.com