দীন প্রচারে ইন্টারনেট : সময়ের দাবি
আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা : মো: আবদুল কাদের
(ক)
গত বছর ঢাকার মালিবাগ জামিয়ার ৩০ সালা সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এক মার্কিন বাঙালী মুসলিমের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। সাইদ নামের এই সৌম্য-ভদ্র মিষ্টি চেহারার তরুণটি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। বাবা-মা’র জন্ম বাংলাদেশে হলেও একজন আমেরিকান হিসেবেই তার জন্ম। অন্য দশজন মার্কিন শিশুর মতই তিনি বড় হন ইসলামের নাম-নিশানাহীন সেক্যুলার পরিবেশে। নিজের বাবা-মাকেও দেখেন তিনি অন্য শিশুদের বাবা-মা’র অনুরূপ। ফলে ইসলাম কী বা মুসলিম আর অমুসলিমের মধ্যে তফাৎ কোথায়- সে ব্যাপারে তিনি কোনো ধারণাই পান নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই নিজের সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন তিনি একজন মুসলিম। তারা বাবা বাংলাদেশ থেকে আসা এক তাবলিগ জামাতের সংস্পর্শে কয়েকদিন কাটানোর পর বাসায় ফিরে তাকে প্রথম কালেমার কথা বলেন। বিস্তারিত শেখার জন্য ছেলেকে তাবলিগে পাঠান। তাবলিগ থেকে ফেরার পর প্রকৌশলী সাইদ ইসলাম নিয়ে পড়াশোনা ও ঘাটাঘাটি শুরু করেন। এরপরের কথাগুলো তার নিজের জবানিতেই শুনুন :
‘আমি তাবলিগ থেকে ফিরে ইসলাম নিয়ে ব্যাপক তথ্য তালাশ শুরু করলাম। যাবতীয় তথ্যের জন্য প্রথমে ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হওয়াই আমাদের অভ্যাস। ইন্টারনেটে ইংরেজি ভাষায় প্রচুর বই ও প্রবন্ধ পেলাম। আমার জ্ঞান পিপাসা মেটাবার কোনো বিষয়েরই অভাব নেই সেখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে এসে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ইঞ্জিয়ারিং শেষ করে ইলমে দীন শেখার জন্য পাকিস্তান বা আরবের কোনো দেশে যাব। কিন্তু স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন করে কোনো দেশের পক্ষ থেকেই সাড়া পেলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সাবজেক্ট নিয়ে পড়েছি তা-ই আমার জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল। পাছে আমি সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাই কি-না সে ভয়ে কোনো মুসলিম দেশই আমাকে সেদেশের প্রতিষ্ঠানে এলেম শেখার সুযোগ দিতে চাইছিল না।
অবশেষে আব্বা-আম্মার নাগরিক হওয়ার সূত্রে বাংলাদেশের ভিসা পেলাম। কিন্তু এদেশের খবর নিয়ে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ আমি ইন্টারনেটে বাংলাদেশের আলেম-উলামা ও মসজিদ-মাদরাসা সম্পর্কে অনেক ঘাটাঘাটি করেও তেমন কিছু পেলাম না। বাংলা ভাষায় নেটে (এটা আরও চার-পাঁচ বছর আগের কথা) ইসলাম সম্পর্কে যা পেলাম তার অধিকাংশই নেতিবাচক। নেটের তথ্য সমুদ্রে উপর্যপুরী সাঁতার কেটেও কেবল একজন বাঙালী মাওলানার নামই উদ্ধার করতে পারলাম। তিনি মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী। এ থেকে আমার ধারণা হল, বাংলাদেশে তেমন কোনো মাওলানা নেই। নেই আমার পড়ার মতো কোনো মাদরাসাও।
তবে উপায়ন্তর আমাকে বাংলাদেশের কথাই ভাবতে হলো। ভাবলাম, আগে তাবলিগ জামাতের সঙ্গে বাংলাদেশটা একবার ঘুরে আসি। অনাবিল সুন্দর এই মুসলিম দেশে গিয়ে কাকরাইলের তাবলিগি মারকাজে পৌঁছেই আমার আক্কেলগুড়ুম। শত শত আলেম-উলামার আনাগোনা! খোদ মারকাজেই দণ্ডায়মান বিশাল মাদরাসা!’ তারপর আমি ঢাকার যেখানেই যাই, সেখানেই দেখি একাধিক মসজিদ-মাদরাসা। আনন্দে হৃদয় দুলে উঠত। গর্বে ফুলে উঠল বুক- এই না আমার পিতৃভূমি মুসলিমের বাংলাদেশ! তবে এত মসজিদ-মাদরাসা ও আলেম-উলামা থাকা সত্ত্বেও আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টারনেটে তাদের উপস্থিতির এই শোচনীয় হাল কেন তা কিছুতেই আমার বোধগম্য নয়।’
(খ)
২০১০ সালের ফেব্রয়ারির ১০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো’য় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেটি এখানে হুবহু তুলে ধরছি। ‘ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট যেসব ধর্মযাজক তাঁদের বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ধর্মযাজকদের ওয়েবসাইটে নিজস্ব ব্লগ খোলার নির্দেশ দিয়েছেন। পোপ গত শনিবার ধর্মীয় বাণী প্রচারের জন্য এবং অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির লোকজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য সম্ভব হলে সব মাল্টিমিডিয়া টুল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। পোপ বেনেডিক্ট এক বার্তায় বলেন, শুধু ই-মেইল ব্যবহার বা ওয়েব সার্ফ করাই যথেষ্ট নয়, নিজেদের প্রকাশ করা এবং নিজ নিজ সম্প্রদায়কে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ধর্মযাজকদের সব ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত। ভ্যাটিকান থেকে প্রকাশিত বার্তায় ৮২ বছর বয়সী পোপ আরও বলেন, তরুণ ধর্মযাজকদের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে বেশি করে পরিচিত হওয়া উচিত। তিনি বিনোদন গণমাধ্যমগুলোর যৌনতা ও সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেন পোপ। তিনি বলেন, প্রযুক্তি মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওয়েবে পোপের উপস্থিতি ব্যাপকভাবে লক্ষ করা গেছে। ভিডিও ও ছবি আদান-প্রদান করার ওয়েবসাইট ইউটিউবে পোপের একটি নিজস্ব চ্যানেল রয়েছে। এই চ্যানেলের মাধ্যমে পোপ তাঁর ধর্মীয় বাণী প্রচার করেন।’
(গ)
ইন্টারনেট কীভাবে ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখছে তার ধারণা দিতে ‘আল-সুন্নাহ’ নামক একটি ইসলামি সাইটের একজন দায়ীর বক্তব্য তুলে ধরছি। সাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট চ্যাটে আমাকে নিউজিল্যান্ডের এক বন্ধু জানিয়েছেন, তিনি বছর তিনেক আগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তার বাবা-মা এখনো এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমেরিকান বোন তরুণী জামিলা জানিয়েছেন, তিনিও ইসলাম গ্রহণ করেছেন ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি ইন্টারনেট থেকে ইসলামি বই-পুস্তক প্রিন্ট করে রাখেন। তারপর সাপ্তাহিক ছুটির দিন সেগুলো মনযোগ দিয়ে পড়েন। তিনি আমার কাছে অনেক ছাত্র ও গবেষকের পক্ষে মেইল করেন। আমি ইসলাম সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞাসার জবাব দেই। আমি সর্বশেষ যে মেইলের জবাব দিয়েছি সেটি পাঠিয়েছেন ১৫ বছর বয়সী এক বৃটিশ তরুণ। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছেন মৃত্যুদণ্ডকে ইসলাম কোন দৃষ্টিতে দেখে? আমি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মেইলও পেয়েছি। তিনি আমার কাছে ইসলাম বিষয়ে অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন।’
প্রথম অনুচ্ছেদে আমরা বাংলাদেশের আলেম-উলামার ইন্টারনেটে অনুপস্থিতির করুণ বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা পাই। বর্তমান বিশ্বে এমন সাইদ হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ নয়; কোটি কোটি। একটু চিন্তা করে দেখুন, শুধু ইন্টারনেটে আলেম-উলামার আনাগোনা না থাকায় একজন প্রকৌশলী বাংলাদেশকে মসজিদ-মাদরাসা আর আলেম-উলামার দিক থেকে কত না কাঙাল ভেবেছিলেন! পক্ষান্তরে ইসলামপন্থীরা যখন ইন্টারনেট থেকে দূরে তখন তাদের বিপক্ষ শক্তিগুলো একে কতটা কাজে লাগাচ্ছেন তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছে প্রথম আলোয় প্রকাশিত দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের এই প্রতিবেদনটি। অনেকে মনে করেন ইন্টারনেটে শুধু খারাপ ছবি আর সিনেমা দেখার কাজ হয়, তাদের ভুল ভেঙ্গে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে তৃতীয় অনুচ্ছেদে তুলে ধরা আরবি একটি প্রবন্ধের এই কিয়দাংশ।
আমরা যারা ইন্টারনেট থেকে দূরে, তারা মনে করি, বাংলাদেশের কয়জনই বা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। আমাদের এ অমূলক ধারণা ভেঙ্গে দিতে একটি তথ্যই যথেষ্ট যে এ দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর প্রিন্ট ভার্সন যতজন পড়েন, তারচেয়েও অনেক অনেক বেশিজন পড়েন ইন্টারনেট ভার্সন। যে পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সনের পাঠক দুই লাখ তার নেট ভার্সনের পাঠক অন্তত তিন লাখ। শীর্ষ দৈনিক প্রথম আলো থেকে নিয়ে পিচ্চি দৈনিক আমাদের সময় পর্যন্ত সবগুলোর নেট ভার্সনের পাঠক প্রিন্ট ভার্সনের দ্বিগুণ বা তারচেয়েও বেশি।
তাছাড়া আমরা জানি, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশে এখন ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়েছে। প্রত্যেক সাংসদকে নেট সংযোগ বিশিষ্ট ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি কলেজ এমনকি স্কুলে পর্যন্ত নেট সংযোগ বিশিষ্ট কম্পিউটার সরবরাহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী এক দেড় বছরের মধ্যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ারও সক্রিয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
শুধু উন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বেই নয়; অনুন্নত বিশ্বেও আজ ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে খুব দ্রুত গতিতে। উন্নত বিশ্বে এখন লেখাপড়া থেকে নিয়ে কেনাকাটা পর্যন্ত সবকিছুই হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশের, অন্তত শহরের কোটি কোটি মানুষও তাদের সব প্রয়োজন মেটাবার জন্য প্রথমে ধর্ণা দেবে ইন্টারনেটের কাছে।
ইন্টারনেটে ইংরেজি ও আরবি ভাষায় একজন সাধারণ মানুষ থেকে নিয়ে বিদগ্ধ গবেষক পর্যন্ত এমন কোনো শ্রেণী নেই যাদের জ্ঞানের পর্যাপ্ত খোরাক নেই। দুনিয়া বা আখিরাতের প্রতুল তথ্য নেই। এর জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওয়েব সাইটের এড্রেস জানারও দরকার হয় না। প্রয়োজনীয় তথ্যের একটি সম্ভাব্য শব্দ দিয়ে গুগলে সার্চ দিলেই উপস্থিত হয় শত শত প্রবন্ধ বা বইয়ের (লিংক) এড্রেস। তারপর সেই এড্রেসে একটি মাত্র ক্লিকেই পেতে পাওয়া যায় কাক্ষিত তথ্য। উদাহরণ স্বরূপ আমার নিজের অভিজ্ঞতাটাই শেয়ার করি। আমি এই প্রবন্ধটি লেখার আগে ইন্টারনেটে আরবি ভাষায় ‘আদ-দাওয়াতু ইলাল্লাহ আবরাল ইন্টারনেট’ (অর্থাৎ, ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার) লিখে সার্চ দিলাম। বেশ এ সম্পর্কে দশ বারোটি প্রবন্ধ পেয়ে গেলাম। বক্ষমাণ নিবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত ‘আল-সুন্নাহ’ সাইটের সন্ধান আমি এভাবেই পেয়েছি। কিন্তু বাংলায় এভাবে কোনো শব্দ দিয়ে ইসলামি কোনো প্রবন্ধ বা বই পাওয়া সহজ নয়।
আরবি এবং ইংরেজি ভাষাভাষীরা তাদের হক যথাযথভাবে আদায় করছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ এই দুই ভাষার পরই পৃথিবীর অন্যতম বহুল ব্যবহৃত ভাষা বাংলায় এর হক প্রায় পুরোটাই অনাদায় রয়ে গেছে। বাংলায় ইসলামের বাইরের বিষয় ইন্টারনেটে অভাব নেই। কিন্তু ইসলামি বিষয় নেই বললেই চলে। যা-ও আছে তার অধিকাংশই বিভিন্ন বিভ্রান্ত মতাদর্শীদের সরবরাহকৃত।
তাই শ্রদ্ধেয় উলামায়ে কেরামের কাছে অনুরোধ, এই অপ্রতিরোধ্য ইন্টারনেট আগ্রাসনের যুগে আপনারা একে আর এড়িয়ে চলবেন না। মন্দের সর্বপ্লাবী বিস্তারের আগেই আপনারাও এগিয়ে আসুন সুন্দরের বিস্তারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।