*ব্যবসা-বাণিজ্য: করনীয় ও বর্জনীয়*
https://youtu.be/fS3xs1lE3bY
1. ভূমিকা
2. ব্যবসা-বাণিজ্য
3. ব্যবসায়ীদের দুই ধরনের লাভ
4. ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি
5. ১. ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না
6. ২. ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি করা যাবে না
7. ৩. মিথ্যার আশ্রয় নেয়া যাবে না
8. ৪. ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না
9. ৫. পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না
10. ৬. নিজে ঠকা যাবে না এবং অপরকেও ঠকানো যাবে না
11. ৭. ব্যবসার সাথে সুদকে মেশানো যাবে না
12. ৮. অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা হতে বিরত থাকা
13. ৯. অপরের মাল হনন করার চেষ্টা করা যাবে না
14. ব্যবসায়ী ভাইদের করণীয়
15. ১. যাকাত দেওয়া
16. ২. লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করা
17. ৩. খাদ্যে ভেজাল মেশানো থেকে বিরত থাকা
18. ৪. উপকার করার মানসিকতা পোষণ করা
19. ৫. মানব সেবার কাজে মনোযোগ দেওয়া
ভূমিকা
ব্যবসা-বাণিজ্য:
হালাল রিযিক আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতে মানুষের জন্য বিভিন্নভাবে ব্যবস্থা করে থাকেন। হালাল রিযিক উপার্জন করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিকে আল্লাহ তা‘আলা স্বীকৃতি দিয়েছেন। হালাল জীবিকা উপার্জনের যত পদ্ধতি আছে, ব্যবসা-বাণিজ্যই এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসাই উপার্জনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রাধান্যের অন্তর্নিহিত রহস্য সবচেয়ে বেশি ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ অঙ্গনে যে জাতি যত বেশি মনোযোগী হয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারাই তত বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে।
ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব এবং ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ ٢٩﴾ [النساء : ٢٩]
“তোমরা একে অপরের ধনসম্পদ অবৈধ উপায়ে আত্মসাৎ করো না। পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করো”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
একজন মানুষের জন্য তার অপর ভাইয়ের সম্পদ কখনোই বৈধ হয় না। বৈধ হওয়ার একমাত্র উপায় হলো, বিনিময় বা ব্যবসা। উভয়ের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয়, তাতে একে অপরের সম্পদকে নিজের জন্য হালাল করে নিতে পারে এবং অপরের সম্পদের মালিকানা অর্জন করতে পারে। একেই বলা হয় ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জন করা বা হালাল রুজী উপার্জন করা।
এ ধরনের উপার্জনকে হাদীসে উত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أفضل الكسب عمل الرجل بيده، وكل بيع مبرور».
“উত্তম কামাই হলো, একজন মানুষের তার নিজের হাতের কামাই এবং সব ধরনের মাবরুর ব্যবসা-বাণিজ্যের কামাই”।[1]
মাবরুর ব্যবসা হলো, যে বেচা-কেনাতে কোনো প্রকার ধোঁকা, খিয়ানত, মিথ্যা ও প্রতারণা থাকে না। পক্ষান্তরে যে ব্যবসার সাথে মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা ও খিয়ানতের সংমিশ্রণ ঘটে তাকে মাবরুর বলা যাবে না। এ ধরনের ব্যবসায়ীকে সত্যিকার ব্যবসায়ী বলা যাবে না। কিয়ামতের দিন ফাজের (অপরাধী) লোকদের সাথে হাশরের মাঠে তাদের পূণরুত্থান হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُونَ يَوْمَ القِيَامَةِ فُجَّارًا، إِلَّا مَنْ اتَّقَى اللَّهَ، وَبَرَّ، وَصَدَقَ» هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ».
“অবশ্যই ব্যবসায়ীদের কিয়ামতের দিন ফাজের হিসেবেই উপস্থিত করা হবে। তবে যে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, সৎ কর্ম করে ও সত্য কথা বলে, তাকে ছাড়া”।[2]
মুমিন ব্যবসায়ীদের গুণাগুণ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿رِجَالٞ لَّا تُلۡهِيهِمۡ تِجَٰرَةٞ وَلَا بَيۡعٌ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَإِقَامِ ٱلصَّلَوٰةِ وَإِيتَآءِ ٱلزَّكَوٰةِ يَخَافُونَ يَوۡمٗا تَتَقَلَّبُ فِيهِ ٱلۡقُلُوبُ وَٱلۡأَبۡصَٰرُ ٣٧ لِيَجۡزِيَهُمُ ٱللَّهُ أَحۡسَنَ مَا عَمِلُواْ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضۡلِهِۦۗ وَٱللَّهُ يَرۡزُقُ مَن يَشَآءُ بِغَيۡرِ حِسَابٖ ٣٨﴾ [النور : ٣٧، ٣٨]
“এমন লোকেরা, যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয় বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে, সালাত কায়েম করা থেকে এবং যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। তারা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে, যাতে আল্লাহ তাদের উৎকৃষ্টতর কাজের প্রতিদান দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও অধিক দেন। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত রিযিক দান করেন”। [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩৭-৩৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشُّهَدَاءِ».
“সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ীগণ হাশরের দিন নবী, শহীদ ও সত্যবাদীদের সঙ্গে অবস্থান করার সৌভাগ্য অর্জন করবে”।[3]
ব্যবসায়ীদের দুই ধরনের লাভ:
ব্যবসা ব্যবসায়ীদের জন্য দুই ধরণের লাভ বয়ে আনবে। যথা-
এক- দুনিয়াতে ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দ্বারা সুন্দর জীবন যাপন করার সুযোগ লাভ। দুনিয়ার জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلۡمَالُ وَٱلۡبَنُونَ زِينَةُ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ ٤٦﴾ [الكهف: ٤٦]
“তোমাদের সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা”। [সূরা কাহাফ, আয়াত: ৪৬]
অর্থ-কড়ি দুনিয়ার জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থ ছাড়া মানুষ দুনিয়ার জীবন পরিচালনা করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿ وَلَا تَنسَ نَصِيبَكَ مِنَ ٱلدُّنۡيَاۖ ٧٧ ﴾ [القصص: ٧٧]
“তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না”। [সূরা ¬আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭] যদিও কেউ কেউ ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
দুই- আখিরাতে উত্তম পুরস্কার। ব্যবসা আল্লাহর রাস্তায় আত্মসমর্পণের কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ব্যবসা তাকওয়া অনুশীলনের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। হারাম হালাল মেনে ব্যবসা করা, সুদ, প্রতারণা ইত্যাদি থেকে বিরত থেকে ব্যবসা করা তাকওয়ার অনুশীলন বৈ আর কি হতে পারে। সালাতের আযান দেওয়ার সাথে সাথে সব ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে মসজিদে গমন আখিরাতের পুণ্য হাসিলের অনন্য মাধ্যম। সালাত যেমন একটি বিশেষ উপলক্ষ্য, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের অতীত কর্মকাণ্ডের পোস্টমর্টেম করি, আনুগত্যের নবায়ন করি, আল্লাহর খাটি বান্দা হওয়ার জন্য বেচে থাকার আশা করি, তাকওয়ার প্রার্থনা করি এবং সাহায্য চাই। অন্যদিকে হালাল ব্যবসা করাও আল্লাহর দেওয়া শরীয়তের কার্যক্রমের অংশ এবং ব্যাপক ও বিস্তৃত অর্থে অনুরূপ ইবাদাতের শামিল। যদি আমরা আমাদের ব্যবসায়িক কাজ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী করতে পারি।
ইসলামে ব্যবসার মূলনীতি
ইসলাম মানুষকে কোনো ক্ষেত্রেই বল্গাহীন স্বাধীনতা দেয় নি। সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা। আয়-উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটে নি। এ ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে ইসলামের দু’টি মূলনীতি রয়েছে।
এক- ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও কায়কারবারগুলো বৈধ হতে হবে। অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ও অবৈধ কায়কারবারকে ইসলাম বৈধতা দেয় না। যেমন, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া ইসলামে অনুমোদন নেই। কারণ, এসব বিষয়কে ইসলামে মৌলিকভাবেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার ব্যবসার সাথে এসবের সংমিশ্রণ আপনার ব্যবসাকে কলুষিত করে।
দুই- ব্যবসা-বাণিজ্য সকল অবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে ইসলামের কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি আমরা নিম্নে আলোচনা করছি-
১. ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না:
ব্যবসা দ্বারা মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত দেন যে,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَضَى أَنْ لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ».
“নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়”।[4]
ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা শুধু লাভ করছি তা নয়; বরং আমরা তাদের জিনিস ও সেবা প্রদান করছি। যদি আমরা যৌক্তিক লাভ করে থাকি এবং মনোপলি না করি তবে সমাজের জন্য এটি একটি বড় সহায়তা। ভালো জিনিস যৌক্তিক দামে প্রদান করায় সমাজের মানুষ সন্তুষ্ট হবে, তাতে আল্লাহ তা‘আলাও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন।
যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি তখন সেখানে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য প্রয়োজন। এতে উভয় পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাওয়াব পাবেন।
২. ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি করা যাবে না:
এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا، فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلًا فَقَالَ: «مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ؟» قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: «أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَيْ يَرَاهُ النَّاسُ، مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي».
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে খাবারের পন্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়”।[5]
৩. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না:
মিথ্যা অবশ্যই একটি নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। ব্যবসার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কোনো মুসলিম সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্যকে গোপন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢﴾ [البقرة: ٤٢]
“তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না”।[6]
একজন মুমিনের দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক, যা মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু একজন মুমিনের মধ্যে মিথ্যা ও খিয়ানতের দোষ থাকাকে কোনোক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো,
«أيكون المؤمن جبانًا؟ قال: نعم. قيل: أيكون بخيلاً؟ قال: نعم. قيل: أيكون كذابًا؟ قال: لا».
“একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন, হ্যাঁ- হতে পারে। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন মিথ্যুক হতে পারে? বললেন, “না”।[7]
হাদীসে একজন মুমিনের অন্যান্য দুর্বলতা বা দোষের কথা স্বাভাবিক বলা হলেও মিথ্যাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া হয় নি।
এ কারণেই তুমি দেখতে পাবে, যে ব্যবসায়ী সত্যবাদী, আমানতদার-মিথ্যা কথা বলে না, খিয়ানত করে না- তার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ে। তার ব্যবসা দৈনন্দিন উন্নত হতে থাকে। তার দোকানে গ্রাহকের ভিড় বাড়তে থাকে। তার কাছে মানুষ আমানত রাখে, তার সাথে মানুষ লেন-দেন বাড়াতে থাকে। ফলে দেখা যায় সে এক সময় বড় একজন ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে যে মিথ্যা কথা বলে, মানুষ তার কাছে ভিড়তে চায় না, তার থেকে পলায়ন করে। একে অপরকে বলতে থাকে, তার সাথে তোমরা কোনো ধরনের লেন-দেন করবে না। তার মো‘আমালা সঠিক নয়। ফলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তার ব্যবসা লাভের পরিবর্তে লসের দিকে যায়। মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বিলুপ্ত হতে থাকে। মান-সম্মান সব ধুলায় মিশে যায়। তার রিযিকের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্যেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أربع إذا كن فيك فلا عليك مما فات من الدنيا: حفظ أمانة، وصدق حديث، وحسن خليقة، وعفة في طعمة»[8].
“চারটি গুণ যখন তোমার মধ্যে থাকবে, তখন দুনিয়াদারী সব খুঁয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমানত সংরক্ষণ, কথায় সততা, উত্তম চরিত্র, হালাল খাদ্য”।
এ চারটি গুণ এমন, যেগুলো কোনো ব্যবসায়ীর মধ্যে বিদ্যমান থাকলে, অবশ্যই তার ব্যবসার উন্নতি হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যবসা বাণিজ্যে বরকত দেবেন এবং এ ধরনের ব্যবসায়ী মানুষের নিকট প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হবে। দুনিয়াতেও তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে, আখেরাতে তো বটেই; কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, আমরা আমাদের পণ্যগুলো বিক্রির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকি। এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ, যা কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। সাময়িক লাভবান হলেও পরিণতি খুবই করুণ।
৪- ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না:
অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيۡلٞ لِّلۡمُطَفِّفِينَ ١ ٱلَّذِينَ إِذَا ٱكۡتَالُواْ عَلَى ٱلنَّاسِ يَسۡتَوۡفُونَ ٢ وَإِذَا كَالُوهُمۡ أَو وَّزَنُوهُمۡ يُخۡسِرُونَ ٣﴾ [المطففين: ١، ٣]
“ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়”। [সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত: ১-৩]
সুতরাং তুমি যখন কাউকে দেবে তখন কম দেবে না। তুমি যে কাজটি তোমার নিজের জন্য পছন্দ করো না, তা অন্যের জন্য কীভাবে পছন্দ কর। তুমি যখন নিজের জন্য নাও তখনতো তোমাকে মাপে কম দিলে তুমি রাজি হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ».
“তুমি তোমার নিজের জন্য যা ভালোবাসো তা অন্যের জন্যও ভালোবাসার আগ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না”।[9]
শু‘আইব আলাইহিস সালাম যে নীতি বর্ণনা করেন, কুরআন তা তুলে ধরছেন এভাবে:
﴿وَإِلَىٰ مَدۡيَنَ أَخَاهُمۡ شُعَيۡبٗاۚ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥۖ وَلَا تَنقُصُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَۖ ٨٤﴾ [هود: ٨٤]
“হে আমার কাওম! আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মা‘বুদ নাই। আর পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না”। [সূরা সূরা হূদ, আয়াত: ৮৪]
﴿وَيَٰقَوۡمِ أَوۡفُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا تَبۡخَسُواْ ٱلنَّاسَ أَشۡيَآءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٨٥﴾ [هود: ٨٥]
“আর হে আমার জাতি! ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে পরিমাপ কর ও ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না”। [সূরা হূদ, আয়াত: ৮৫]
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَوۡفُواْ ٱلۡكَيۡلَ إِذَا كِلۡتُمۡ وَزِنُواْ بِٱلۡقِسۡطَاسِ ٱلۡمُسۡتَقِيمِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلٗا ٣٥﴾ [الاسراء: ٣٥]
“মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক পাল্লায় ওজন করবে। এটি উত্তম, এর পরিণাম শুভ”। [সূরা বনী ঈসরাইল, আয়াত: ৩৫]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “…যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্য-শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে”।[10]
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, “…যে জাতি মাপে ও ওজনে কম দেয়, তাদের রিযিক উঠিয়ে নেওয়া হয়…”।[11]
মনে রাখতে হবে, সালাত, সাওম ইত্যাদি নেক আমলে ত্রুটি হলে আল্লাহ তা‘আলা হয়তো তা তার নিজের অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেবেন; কিন্তু মানুষকে সামান্য অণু পরিমাণ ঠকানো হলে বা অণু পরিমাণ মানুষের হক নষ্ট করলে, এ দায়ভার কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা নিবেন না। কিয়ামতের দিন প্রতারিত ক্রেতাকে ডেকে আল্লাহ তা‘আলা ওই প্রতারকের আমলনামা থেকে সমপরিমাণ সাওয়াব তাকে দিয়ে দেবেন। প্রতারকের সাওয়াব যদি শেষ হয়ে যায় বা কোন সাওয়াব না থাকে, তবে প্রতারিতদের গোনাহ তাঁর কাঁধের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে যদি শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে রক্তও প্রবাহিত হতে থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না। সেদিন এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কোনক্রমেই ক্ষমা করবে না, যদি প্রতারিত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করেন।
৫-পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না:
মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: الْمَنَّانُ الَّذِي لَا يُعْطِي شَيْئًا إِلَّا مَنَّهُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْفَاجِرِ، وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ».
“কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন- যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে”।[12]
অপর একটি হাদীসে এ দৃষ্টান্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
«رجل حلف على سلعة بعد العصر، لقد أعطي بها كذا، وكذا، فصدقه المشتري وهو كاذب».
“এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, তাকে পণ্যটি এত এত মূল্যে দেওয়া হয়েছে। তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করল, অথচ সে মিথ্যুক”।[13]
এ ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য উল্লিখিত হাদীসে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
৬- নিজে ঠকা যাবে না এবং অপরকেও ঠকানো যাবে না:
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে অভিযোগ করল, যে সে বেচা-কেনাতে প্রতারিত হয় বা ঠকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«إِذَا أَنْتَ بَايَعْتَ، فَقُلْ: لَا خِلَابَةَ، ثُمَّ أَنْتَ فِي كُلِّ سِلْعَةٍ ابْتَعْتَهَا بِالْخِيَارِ ثَلَاثَ لَيَالٍ».
“যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন তুমি বলে দিবে যে কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে”।[14]
৮-ব্যবসার সাথে সুদকে মেশানো যাবে না:
সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোন প্রকার সুদ চালু করা যাবে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ ٢٧٥﴾ [البقرة: ٢٧٥]
“যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) ওতো সুদের মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِي ٱلصَّدَقَٰتِۗ ٢٧٦﴾ [البقرة: ٢٧٦]
“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খায়রাতকে বর্ধিত করেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৬]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا أَحَدٌ أَكْثَرَ مِنَ الرِّبَا، إِلَّا كَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهِ إِلَى قِلَّةٍ».
“সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা”।[15]
লেনদেন যদি সুদ সংক্রান্ত হয় তবে হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে,
«لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ» ، وَقَالَ: «هُمْ سَوَاءٌ».
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী সকলের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন তারা সকলেই সমান”।[16]
৯-অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা হতে বিরত থাকা:
বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ হতে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুযাবানা বলে। বিভিন্ন ধরণের মুযাবানা বর্তমানেও প্রচলিত আছে। ক্ষেতে অকীর্তিত খাদ্য শস্য যথা গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনা পরিষ্কার করা খাদ্য যথা, গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুহাকালা বলে। সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।[17]
১০-অপরের মাল হনন করার চেষ্টা করা যাবে না:
ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ ٢٩﴾ [النساء : ٢٩]
“হে ঈমানদারগন তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
হাদীসে এসেছে একটি ব্যবসায়িক লেনদেনে উভয় পক্ষই খুঁতসহ পণ্যেও সঠিক বর্ণনা দিতে হবে। ইসলামের বিজনেস কন্ডাক্ট সম্পর্কে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু এভাবে বর্ণনা করেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«رَحِمَ اللَّهُ رَجُلًا سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى».
“আল্লাহ তার প্রতি দয়া বর্ষণ করুক যে বিক্রির সময়, ক্রয়ের সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে”।[18]
ব্যবসায়ী ভাইদের করনীয়
১. যাকাত দেওয়া:
যখন আমাদের ব্যবসার লাভের কারণে নিসাব পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হব, তখন ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি যাকাতের আমল আমাদের দ্বারা পালন হবে। এর মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন হবে। ধনী ও গরীবের মাঝে সেতু বন্ধন রচনা হবে। যাকাত সম্পদের ময়লা-আবর্জনা। যাকাত দিয়ে সম্পদকে ময়লা আবর্জনা থেকে পরিষ্কার করতে হয়। যাকাত কখনো সম্পদ কমায় না। যাকাত সম্পদ বাড়ায়। যাকাত দেওয়া দ্বারা ব্যবসায়ী তার সম্পদকে কলুষমুক্ত করল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن رِّبٗا لِّيَرۡبُوَاْ فِيٓ أَمۡوَٰلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرۡبُواْ عِندَ ٱللَّهِۖ وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن زَكَوٰةٖ تُرِيدُونَ وَجۡهَ ٱللَّهِ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُضۡعِفُونَ ٣٩﴾ [الروم: ٣٩]
“আর তোমরা যে সুদ দিয়ে থাক, মানুষের সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য তা মূলতঃ আল্লাহর কাছে বৃদ্ধি পায় না। আর তোমরা যে যাকাত দিয়ে থাক আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে (তাই বৃদ্ধি পায়) এবং তারাই বহুগুণ সম্পদপ্রাপ্ত”। [সূরা রূম, আয়াত: ৩৯]
আয়াত দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, যাকাত দ্বারাই সম্পদ বৃদ্ধি পায় সুদ নয়। সুদের পরিণতি খুবই করুণ। সুদ পরিহার করা ও তা থেকে দূরে থাকার জন্য আমাদের সর্বাত্মক সতর্ক থাকতে হবে।
২. লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি অনুসরণ করা:
ব্যবসায়িক যে কোনো লেনদেন ও কারবারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِذَا تَدَايَنتُم بِدَيۡنٍ إِلَىٰٓ أَجَلٖ مُّسَمّٗى فَٱكۡتُبُوهُۚ وَلۡيَكۡتُب بَّيۡنَكُمۡ كَاتِبُۢ بِٱلۡعَدۡلِۚ﴾ [البقرة: ٢٨٢]
“হে মুমিনগণ যখন তোমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের আদান প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দিবে; …দু’জন সাক্ষী কর,…। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৮২]
৩. খাদ্যে ভেজাল মেশানো থেকে বিরত থাকা:
খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণকারী লোকদের সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। তাদের বিশ্বাস করে না, অন্তর থেকে সম্মান করে না। দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও ব্যর্থতা নিজের চোখেই দেখতে পারে। পরকালের কঠিন শাস্তি তো তাদের ভোগ করতে হবেই। ইদানীং শুধু ভেজাল নয়, বিভিন্ন আধুনিক নামের বিষও মেশানো হয়। এমনকি ভেজাল ওষুধেরও বাজারে ছড়াছড়ি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَتَبَدَّلُواْ ٱلۡخَبِيثَ بِٱلطَّيِّبِۖ ٢﴾ [النساء : ٢]
“এবং তোমরা অপবিত্র বস্তুকে পবিত্র বস্তু দ্বারা পরিবর্তন করো না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২]
৪. উপকার করার মানসিকতা পোষণ করা:
যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি তখন সেখানে একটি হৃদ্যতা পূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য প্রয়োজন। এতে উভয় পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সওয়াব পাবেন।
৫. মানব সেবার কাজে মনোযোগ দেওয়া:
ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা শুধু লাভ করছি তা নয়; বরং আমরা তাদের জিনিস ও সেবা প্রদান করছি। এটি নবীদের সামাজিক কর্মসূচীর মতো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«التَّاجِرُ الصَّدُوقُ الأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ، وَالصِّدِّيقِينَ، وَالشُّهَدَاءِ».
“সত্যবাদী ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ীগণ বিচার দিবসে নবী, ওলী ও শহীদগণের সাথে অবস্থান করবে”।[19]
ব্যবসায়ীদের খুশি হওয়া উচিৎ যে, তারা অন্যের জন্য চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি করেন। একজনের চাকুরী হওয়ার অর্থ হচ্ছে একটি বেকারত্ব কমল, একজনের হালাল আয়ের পথ প্রশস্ত হলো, রাষ্ট্রের মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটল -এ সবই ইসলামের নির্দেশ।
মোটকথা, ব্যবসা শুধু আয়-রোজগারে একটি ব্যবস্থার নাম নয়। ব্যবসার সাথে যেমনিভাবে মানুষের জীবন-জীবিকার সম্পর্ক, অনুরূপভাবে রয়েছে সামাজিক, মানবিক ও ইসলামী আদর্শ সহ বিভিন্ন কর্মসূচী ও বাস্তব-ধর্মী পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সত্যিকার ব্যবসায়ী হওয়ার তাওফীক দিন। আমীন
[1] মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ১৭২৬৫
[2] তিরমিযী, হাদীস নং ১২১০। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[3] তিরমিযী, হাদীস নং ১২০৯
[4] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৩৪১
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২
[6] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪২
[7] বাইহাকী শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৪৮১২। হাদীসটি সহীহ।
[8] মুসনাদে আহমাদ (৬৬৫২) ও ত্বাবরানী, হাসান সনদে।
[9] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩
[10] আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং ৭৮৫
[11] মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং ৫৩৭০
[12] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৬
[13] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৪৭৪; নাসায়ী, হাদীস নং ৪৪৬২
[14] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৬৪
[15] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২২৭৯
[16] সহীহ মুসলিম নং ১৫৯৮
[17] ইবন কাসীর
[18] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০৭৬
[19] তিরমিযী, হাদীস নং ১২০৯
________________________________
লেখক: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
উৎস: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ, সৌদিআরব।।