রজব মাস: এ সব বিদয়াত দূর হওয়া আবশ্যক

অনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

১) ভূমিকা

সম্মানিত পাঠক, আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য দিয়েছেন মহা গ্রন্থ আল কুরআনুল কারীম এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ। তাই বিদাআতীর বিদআত অনুসরণ করার প্রতি আমরা মুখাপেক্ষী নই। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:

 اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ

“তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতি পালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য সাথীদের অনুসরণ করো না। (সূরা আরাফ: ৩)

আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের যাবতীয় বিধানকে দিবালোকের মত সুস্পষ্টভাবে আমাদের জন্য বর্ণনা করে দিয়েছন। তিনি মুসলিম উম্মাহর নিকট আল্লাহর সত্য বাণীকে পৌঁছে দিতে সামান্যতম কার্পণ্য করেন নি। সাহাবীগণ ও সত্যকে মনে-প্রাণে ও বাস্তব জীবনে এ সত্যের সাক্ষ্য দিয়ে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করেছেন। এই পথ থেকে শুধু হতভাগ্যরাই বিচ্যুত হয়। তাই আমাদের কর্তব্য কুরআন-সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং সকল ধরণের বিদআত থেকে দূরে থাকা।

সম্মানিত পাঠক, আমরা দেখি রজব মাসকে কেন্দ্র করে অনেক মুসলমান এমন অনেক কার্যক্রমে লিপ্ত হয় যার ব্যাপারে কুরআন-সু্‌ন্নাহর বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ নেই। যেমন, রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে কিছু রোযা রাখা, ইবাদত-বন্দেগী করা, রজবী উমরা পালন করা, মেরাজ দিবস কিংবা শবে মেরাজ পালন করা  ইত্যাদি। তাছাড়া রজব মাসের ফযিলতে এমন অনেক হাদীস পেশ করা হয় যেগুলো হাদীস বিশারদগণের দৃষ্টিতে হয় দুর্বল না হয় বানোয়াট।

) রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করার কথা কি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে?

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন:

“রজব মাসের মর্যাদার ব্যাপারে অথবা রজব মাসে বিশেষভাবে কোন ধরণের নফল নামায-রোযা কিংবা এর কোন নির্দিষ্ট রাতে ইবাদত-বন্দেগী করার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য কোন হাদীস বর্ণিত হয় নি। আমার আগে এ কথাটি ইমাম হাফেয আবু ইসমাইল আল হারাবী দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন। আমি এ কথা তার নিকট থেকে এবং আরও অন্যান্য মনিষীদের নিকট থেকে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছি।” (তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফাযলি রাজাব)

এর পর তিনি এ প্রসঙ্গে বর্ণিত বেশ কিছু যঈফ ও জাল হাদীস উল্লেখ করেছেন। নিন্মে অতি সংক্ষেপে সেগুলো থেকে কয়েকটি হাদীস পেশ করব ইনশাআল্লাহ।

) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি দুর্বল হাদীস:

১) “জান্নাতে একটি নহর আছে যাকে বলা হয় রজব। যার পানি দুধের চেয়ে সাদা, মধুর চেয়েও মিষ্টি। যে ব্যক্তি রজব মাসে একদিন রোযা রাখবে তাকে সেই নহরের পানি পান করতে দেয়া হবে।”

ইবনে হাজার রহ. বলেন: হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, আবুল কাসেম আত তাইমী তার আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে, হাফেয আসপাহানী ফাযলুস সিয়াম কিতাবে, বাইহাকী, ফাযায়েলুল আওকাত কিতাবে, ইবনু শাহীন আত তারগীব ওয়াত তারহীব কিতাবে।

এ হাদীসটি দুর্বল। ইবনুল জাওযী ইলালুল মুতানাহিয়া গ্রন্থে বলেন: এ হাদীসের বর্ণনা সূত্রে একাধিক অজ্ঞাত রাবী রয়েছে। তাই এ হাদীসের সনদ দুর্বল। তবে বানোয়াট বলার মত পরিস্থিতি নেই। এর আরও কয়েকটি সূত্র রয়েছে কিন্তু সেগুলোতেও একাধিক অজ্ঞাত বর্ণনাকারী রয়েছে। [দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব (পৃষ্ঠা নং ৯, ১০ ও ১১), আল ইলালুল মুতানাহিয়া, (২য় খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)।]

২) “আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবা ওয়া শাবানা ও বাল্লিগনা রামাযান।”

“হে আল্লাহ তুমি রজব ও শাবানে আমাদেরকে বরকত দাও। আর আমাদেরকে রামাযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।” (মুসনাদ আহমাদ  ১/২৫৯)

হাদীসটি দুর্বল।

এ হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যার নাম যায়েদাহ বিন আবুর রিকাদ। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. বলেন:  মুনকারুল হাদীস। ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে তার নিকট থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন: চিনি না এই ব্যক্তি কে?  আর তিনি তার যুয়াফা কিতাবে বলেন: মুনকারুল হাদীস। কুনা গ্রন্থে বলেন: “তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবনে হিব্বান বলেন: তার বর্ণিত কোন হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফযলি রাজাব, ১২ পৃষ্ঠা। আয যুয়াফাউল কাবীর (২/৮১) তাহযীবুত তাহযীব (৩/৩০)

৩) “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযানের পরে রজব ও শাবান ছাড়া অন্য কোন মাসে রোযা রাখেন নি।” (বাইহাকী)

হাফেয ইবনে হাজার বলেন: উক্ত হাদীসটি মুনকার। কারণে, এর সনদের ইউসুফ বিন আতিয়া নামক একজন রাবী রয়েছে। সে খুব দূর্বল। (তাবয়ীনুল আজাব ১২ পৃষ্ঠা)

) রজব মাস সম্পর্কে কয়েকটি জাল হাদীস:

১) রজব আল্লাহর মাস, শাবান আমার মাস এবং রামাযান আমার উম্মতের মাস।”

এটি জাল হাদীস।

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, উক্ত হাদীসটি বর্ণনাকারীদের মধ্যে আবু বকর আন নাক্কাশ নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। সে কুরআনের মুফাসসির। কিন্তু লোকটি জাল হাদীস রচনাকারী এবং চরম মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। ইবনে দেহিয়া বলেন: এই হাদীসটি জাল। (তাবয়ীনুল আজব, ১৩-১৫ পৃষ্ঠা) এছাড়াও উক্ত হাদীসকে জাল বলে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী তার আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৫-২০৬) এবং ইমাম সানয়ানী মাওযূআত কিতাবে (৬১ পৃষ্ঠা) এবং সূয়ূতী তার আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৪)।

২) কুরআনের মর্যাদা সকল যিকির-আযকারের উপর যেমন রজব মাসের মর্যাদা অন্যান্য মাসের উপর তেমন।”

হাদীসটি বানোয়াট।

ইবনে হাজার আসকালানী উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন, এই হাদীসটি সনদের রাবীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য একজন ছাড়া। তার নাম হল, সিকতী। আর এ লোকটিই হল বিপদ। কেননা, সে একজন বিখ্যাত জাল হাদীস রচনাকারী। (তাবয়ীনুল আজাব: ১৭ পৃষ্ঠা)

৪) রজব মাসে যে ব্যক্তি তিনটি রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তার আমলনামায় একমাস রোযা রাখার সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন, আর যে ব্যক্তি সাতটি রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করে দিবেন।”

হাদীসটি জাল।

এটিকে জাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৬), সূয়ূতী আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৫), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (১০০ পৃষ্ঠা, হাদীস নং ২২৮) এবং তাবয়ীনুল আজাব কিতাবে (১৮ পৃষ্ঠা)।

৫) “যে ব্যক্তি রজবের প্রথম তারিখে মাগরিব নামায আদায় করত: বিশ রাকায়াত নামায পড়বে, প্রতি রাকায়াতে সূরা ফাতিহা এবং সূরা ইখলাস একবার করে পড়বে এবং প্রতি দু রাকায়াত পরপর সালাম ফিরিয়ে মোট দশ সালামে বিশ রাকায়াত পূর্ণ করবে তোমরা কি জানেন তার সওয়াব কি?…তিনি বলেন: আল্লাহ তায়ালা তাকে হেফাজত করবেন এবং তার পরিবার, সম্পত্তি ও সন্তান-সন্ততীকে হেফাজত করবেন, কবরের আযাব থেকে রক্ষা করবেন এবং বিনা হিসেব ও বিনা শাস্তিতে বিদ্যুৎ গতিতে পুলসিরাত পার করাবেন।”

 এটি একটি বানোয়াট হাদীস।

(দ্রষ্টব্য: ইবনুল জাউযী তার মাওযূয়াত (২/১২৩), তাবয়ীনুল আজাব (২০ পৃষ্ঠা), আল ফাওয়াইদুল মাজমূয়াহ (৪৭পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৪)।)

৫) “যে ব্যক্তি রজব মাসে রোযা রাখবে এবং চার রাকায়াত নামায পড়বে সে জান্নাতে তার নির্ধারিত আসন না দেখে মৃত্যু বরণ করবে না।”

হাদীসটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/১২৪), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (৪৭ পৃষ্ঠা) এবং তাবয়ীনুল আজাব, (২১ পৃষ্ঠা)।

৬) সালাতুর রাগায়েব নামায সম্পর্কিত হাদীস। হাদীসটি হল:

”রজবের প্রথম শুক্রবার রাতটি ব্যাপারে তোমরা গাফলতি কর না। কারণ, ফেরেশতাগণ এ রাতটিকে রাগায়েব বলে আবিহিত করেন। এ রাতে শেষভাগে আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত এমন কোন ফেরেশতা বাকি থাকে না যারা কাবা শরীফ এবং তার চারপাশে এসে একত্রিত না হয়। তারপর আল্লাহ তায়ালা তাকিয়ে দেখে ফেরেশতাদেরকে বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ, তোমরা যা খুশি আমার নিকট চাও। তারা বলেন: হে আল্লাহ তোমার নিকট দরখাস্ত পেশ করছি যে, যে সকল লোক  রজব মাসে রোযা রাখে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ঠিক আছে, তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। অত:পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি রজব মাসের প্রথম বৃহ:পতিবার দিনে রোযা রাখবে এবং শুক্রবার রাতে মাগরিব ও ইশার মধ্যবর্তী সময়ে বার রাকায়াত নামায পড়বে…।”

এ হাদীসটি জাল।

দেখুন: ইবনুল জাওযী রচিত আল মাওযূয়াত ২/১২৪-১২৬, তাবয়ীনুল আজাব (২২-২৪পৃষ্ঠা), আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূয়া, (৪৭-৫০ পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৬)

৭) নিশ্চয় রজব একটি মহান মাস। যে ব্যক্তি এ মাসের কোন একদিন রোযা রাখবে আল্লাহ তায়ালা এর বিনিময়ে তার আমল নামায় এক হাজার বছরের সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন।”

হাদীসটি জাল।

এ হাদীসটিকে জাল বলে আখ্যায়িত করেছেন ইবনু জাওযী আল মাওযূয়াত কিতাবে (২/২০৬-২০৭), সূয়ূতী আল লাআলী আল মাসনূআহ কিতাবে (২/১১৫), শাওকানী আল ফাওয়ায়েদুল মাজমুয়াহ কিতাবে (১০১ পৃষ্ঠা, জাল হাদীস নং ১৪৫) এবং তাবয়ীনুল আজাব, (২৬ পৃষ্ঠা)।

রজব মাস সম্পর্কে এখানে মাত্র কয়েকটি প্রচলিত জাল হাদীস উপস্থাপন করা হল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এমন আরও বহু জাল হাদীস বিভিন্ন কিতাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।  উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, রজব মাসে বিশেষ নামায, রোযা ও ইবাদত-বন্দেগী নাই। বরং এ প্রসঙ্গে অনেক বানোয়াট ফযীলতের কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক পথে সন্ধান দান করুন। আমীন।

 ) রজব মাসকে কেন্দ্র করে নামাযরোযাইতিকাফইত্যাদি ইবাদত করা।

    রজব মাসে বিশেষভাবে নফল রোযা রাখা, নফল নামায পড়া অথবা ইতিকাফ করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআতের অন্তর্ভূক্ত। যারা এ সব করে তারা এমন কিছু হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে যেগুলো দুর্বল অথবা বানোয়াট।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: রজব ও শাবানকে মিলিয়ে একসাথে পুরো দুমাস বিশেষভাবে রোযা রাখা অথবা ইতিকাফ করার সমর্থনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবীগণ, কিংবা মুসলমানের ইমামগণের পক্ষ থেকে কোন প্রমাণ নেই। তবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শাবান মাসে রোযা রাখতেন। তিনি রামাযান মাসের আগমনের প্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে যে পরিমাণ রোযা রাখতেন রামাযান ছাড়া বছরের অন্য কোন মাসে এত রোযা রাখতেন না। (বুখারী, কিতাবুস সাওম, মুসলিম, কিতাবুস সিয়াম)

রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে রোযা রাখার ব্যাপারে কিছু হাদীস দুর্বল আর অধিকাংশই বানোয়াট। আহলে ইলমগণ এগুলোর প্রতি নির্ভর করেন না। এগুলো সে সকল দুর্বল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত নয় যেগুলো ফযীলতের ক্ষেত্রে বর্ণনা করা হয়। বরং অধিকাংশই মিথ্যা ও বানোয়াট। রজব মাসের ফযিলতে সব চেয়ে বেশী যে হাদীসটি বর্ণনা করা হয় সেটা হল এই দুয়াটি:

(( اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان))

“হে আল্লাহ, তুমি আমাদেরকে রজব ও শাবানে বরকত দাও এবং রামাযান পর্যন্ত পৌঁছাও।” [মুসনাদ আহমদ, (১/২৫৯)।]

এ হাদীসটি দুর্বল।

এ হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে যার  নাম যায়েদাহ বিন আবুর রিকাদ। তার ব্যাপারে ইমাম বুখারী রহ. বলেন মুনকারুল হাদীস। ইমাম নাসাঈ তার সুনান গ্রন্থে তার নিকট থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করার পর বলেন: “চিনি না এই ব্যক্তি কে?” আর তিনি তার যুয়াফা কিতাবে তার সম্পর্কে বলেন: মুনকারুল হাদীস। কুনা গ্রন্থে বলেন: তিনি নির্ভরযোগ্য নন। ইবনে হিব্বান বলেন: তার বর্ণিত কোন হাদীসকে দলীল হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। দ্রষ্টব্য: তাবয়ীনুল আজাব বিমা ওয়ারাদা ফী ফযলি রাজাব, ১২ পৃষ্ঠা।  আয যুয়াফাউল কাবীর (২/৮১) তাহযীবুত তাহযীব (৩/৩০)

ইবনে তাইমিয়া রহ. আরও বলেন: “রজব মাসকে বিশেষ সম্মান দেখানো বিদআতের অন্তর্ভুক্ত যা বর্জন করা উচিৎ। রজব মাসকে বিশেষভাবে রোযার মওসুম হিসেবে গ্রহণ করাকে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল সহ অন্যান্য ইমামদের নিকটে অপছন্দনীয়।” (ইকতিযাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, ২য় খণ্ড, ৬২৪ ও ৬২৫ পৃষ্ঠা)

ইবনে রজব বলেন: রজব মাসকে কেন্দ্র করে বিশেষভাবে রোযা রাখার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কিংবা সাহাবীদের থেকে কোন কিছুই সহীহ ভাবে প্রমাণিত হয় নি। কিন’ আবু কিলাবা থেকে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যে, “যারা রজবে বেশী বেশী রোযা রাখবে তাদের জন্য জান্নাতে প্রাসাদ রয়েছে।” এই কথাটির ব্যাপারে ইমাম বায়হাকী বলেন: আবু কিলাবা একজন বড় মাপের তাবেঈ। তার মত ব্যক্তি হাদীসের তথ্য না পেলে এমন কথা বলতে পারেন না।

কিন্তু এ কথার প্রতি উত্তরে বলা যায় যে, ইসমাইল আল হারাবী, শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাজার আসকালানী প্রমুখ আলেমগণ এ মর্মে একমত যে, রজব মাসকে কেন্দ্র করে রোযা রাখার ব্যাপারে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীস প্রমাণিত হয় নি। এ মর্মে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কিছু হল যঈফ আর অধিকাংশই বানোয়াট।

আবু শামা বলেন: কোন ইবাদতকে এমন কোন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করে দেয়া উচিৎ নয় শরীয়ত যেটা নির্দিষ্ট করে নি। বরং ইসলামী শরীয়ত যে সময় যে ইবাদত নির্ধারণ করেছে সেটা ছাড়া যে কোন ইবাদত যে কোন সময় করা যাবে। এক সময়কে অন্য সময়ের উপর প্রাধান্য দেয়া যাবে না।

ইসলামী শরীয়তে বিশেষ কিছু সময়কে নির্ধারণ করা হয়েছে ‘বিশেষ কিছু’ ইবাদতের জন্য। ঐ সময়গুলোতে ঐ ইবাদতগুলোই ফযীলত পূর্ণ; অন্য কোন ইবাদত নয়। যেমন, আরাফাহর দিনে রোযা রাখা, আশুরার দিনে রোযা রাখা, গভীর রাতে নফল নামায পড়া, রামাযান মাসে উমরা আদায় করা।

অনুরূপভাবে এমন বিশেষ কিছু সময়কে নির্ধারণ করা হয়েছে যেগুলোতে ‘যে কোন ধরণের’ নেকীর কাজ করার ফযীলত রয়েছে। যেমন, জিল হজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন, লাইলাতুল কদর যার মর্যাদা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এই রাতে যে কোন ইবাদতই করা হোক তা অন্য হাজার মাসের চেয়েও মর্যাদাপূর্ণ।

মোটকথা, বিশেষ কোন সময়কে বিশেষ কোন ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করার অধিকার কেবল ইসলামী শরীয়তই সংরক্ষণ করে; অন্য কোন ব্যক্তি নয়। আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন। (আল বায়িস, পৃষ্ঠা নং ৪৮)

) সালাতুর রাগায়েব এর বিদআত

রজব মাসের অন্যতম বিদআত হল: সালাতুর রাগায়েব। এ নামাযটি পড়া হয় রজব মাসের প্রথম শুক্রবার মাগরিব ও ইশার মাঝে। আর তার আগের দিন অর্থাৎ বৃহ:বার দিনে রোযা রাখা হয়।

এ নামাযটির ভিত্তি হল একটি বানোয়াট হাদীস। সেই হাদীসে তার ফযীলত ও পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। দেখুন সেই হাদীসটি:

ক) সালাতুর রাগায়েব আদায়ের বানোয়াট পদ্ধতি:

আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: রজব হল আল্লাহর মাস। শাবান আমার মাস আর রামাযান আমার উম্মতের মাস…। কোন ব্যক্তি যদি রজবের প্রথম বৃহ:বার রোযা থাকে এবং শুক্রবার মাগরিব ও ইশার মাঝে বার রাকায়াত নামায পড়ে, প্রতি রাকায়াতে সূরা ফাতিহা পড়বে একবার, সূরা কদর তিন বার, কুল হুওয়াল্লাহু আহাদ বার বার।

প্রতি দু রাকায়াত পর সালাম ফিরাবে, তারপর আমার উপর সত্তর বার দরূদ পড়বে এভাবে: আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মাদিনি নাবিয়্যি ওয়া আ’লা আলিহ অত:পর একটা সাজদাহ দিবে। তাতে পড়বে সুব্বূহুন কুদ্দূসুন, রাব্বুল মালাইকিতি ওয়ার রূহ সত্তর বার। তারপর সাজদাহ থেকে মাথা উঠিয়ে বলবে: রাব্বিগফির লী, ওয়ারহাম, ওয়া তাজাওয়ায আম্মা তা’লাম, ইন্নাকা আনতাল আযীযুল আযীম” সত্তুর বার। অত:পর ২য় সাজদাহ দিবে এবং প্রথম সজদায় যা যা পড়েছে সেগুলো পড়বে। অত:পর আল্লাহর নিকট তার প্রয়োজন তুলে ধরে দুয়া করলে আল্লাহ তা পূরণ করবেন।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সেই স্বত্বার কসম যার হাতে আমার প্রাণ কোন বান্দা অথবা বান্দী যদি এই নামায পড়ে তবে তার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে যদিও তা সাগরের ফেনা এবং বৃক্ষরাজির পাতা সমপরিমাণ হয় এবং তার পরিবার পরিজনের মধ্য থেকে সত্তুর জনের জন্য তার শাফায়াত কবুল করা হবে।

আর কবরের প্রথম রজনীতে এই নামাযের সওয়াব তার সামনে এসে হাজির হবে উজ্জ্বল চেহারা আর মিষ্টভাষী হয়ে আর বলবে, হে আমার বন্ধু, আমি তোমার সেই নামাযের সওয়াব যা তুমি উমুক মাসের উমুক রাতে পড়েছিলে। আজ রাতে তোমার নিকট এসেছি যেন তোমার প্রয়োজন পূরণ করি, তোমার নি:সঙ্গতা ও ভয়-ভীতি দূর করি। যে দিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে সে দিন কিয়ামতের মাঠে তোমার মাথার উপর ছায়া দিব। সুসংবাদ নাও,  তোমার প্রভু থেকে কখনোই কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে না।“

– উক্ত হাদীসটি ইবনুল জাওযী তার মওযূয়াত কিতাবে (২/১২৪-১২৬) উল্লেখ করার পর বলেন: এটি আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর মিথ্যা রোপ ছাড়া কিছু নয়। এ হাদীসটির রচনাকারী হিসেবে যে ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয় সে হল ইবনু জুহাইম। মুহাদ্দিসগণ এ মিথ্যা রোপকে তার দিকেই সম্বোধন করেছেন।

– তিনি বলেন: আমাদের শাইখ আব্দুল ওয়াহাব বলেন: “এ হাদীসটির সনদের বর্ণনাকারীগণ অজ্ঞাত। এদের পরিচয় জানার জন্য  ইলমুর রিজালের কিতাবাদী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও তাদের সম্পর্কে তথ্য পাই নি।”

– শাওকানী তার ফাওয়ায়েদুল মাজমূয়াহ কিতাবে (৪৭-৪৮পৃষ্ঠা) বলেন: এ হাদীসটি বানোয়াট এবং এর বর্ণনাকারীগণ অজ্ঞাত। আর এটাই সালাতুর রাগায়েব নামে পরিচিত। হাফেযুল হাদীসগণ একমত যে, এটি জাল হাদীস।

– ফিরোযাবাদী আল মুখতাসার কিতাবে বলেন: সর্বসম্মতি ক্রমে এটি জাল। অনুরূপ কথা বলেন ইমাম মাকদেসী। এ হাদীসটি রাযীন ইবনে মুয়াবিয়া আল আব্দারীর কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। কিন’ এ ব্যাপারে কথা হল, তিনি তার কিতাবে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে অনেক বানোয়াট ও অদ্ভুত কথা-বার্তা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কোথা থেকে এ সব এনেছেন তা জানা যায় না। এটা মুসলমানদের প্রতি তার বিশ্বাস ঘাতকতা। (দেখুন: আবু শামাহ রচিত আল বায়িস, পৃষ্ঠা নং ৪০)

ইবনুল জাওযী (রহ.) বলেন: এ হাদীসটি বানানোর মাধ্যমে বাড়াবাড়ি রকমের বিদআত চালু করা হয়েছে। কারণ, যে ব্যক্তি এই নামায পড়তে পড়তে চায় তাকে দিনে রোযা রাখতে হবে। দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম থাকলেও হয়ত সে রোযা রাখল। কিন’ ইফতার করার সময় ভাল করে খাওয়া দাওয়া সম্ভব হল না। তারপরও মাগরিব নামায আদায় করার পর লম্বা তাসবীহ আর দীর্ঘ সাজদাহ দিয়ে এই নামায পড়ার কথা বলা হয়েছে। ফলত: সেই ব্যক্তির কষ্ট চরম পর্যায়ে পৌঁছবে।

রামাযান মাস আর রমাযানের তারাবীহের নামাযের ব্যাপারে আমার মনে কষ্ট লাগছে! কিভাবে তথাকথিত এই নামাযকে রামাযান ও তারাবীহের সাথে টক্কর লাগানো হয়েছে!! সাধারণ লোকজনের নিকট তো এটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ হবে। যে ব্যক্তি ফরয নামাযের জামায়াতে শরীক হত না সেও এই নামাযে হাজির হবে।” (মওযূয়াতু ইবনিল জাওযী: ২য় খণ্ড, ১২৫ ও ১২৬ পৃষ্ঠা)

খ) সর্ব প্রথম কোথায় এবং কখন চালু হল এই নামায?

এই নামায সর্ব প্রথম চালু হয় বাইতুল মাকদিসে। সেটা ছিল ৪৮০ হিজরীর পরে। এর আগে কখনো কেউ এ নামায পড়ে নি।

গাযালী উপরোক্ত আনাস রা. এর নামে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করার পর এটির নাম দেন: রজবের নামায। আর বলেন: এটা পড়া মুস্তাহাব!! আরও বলেন: এটি ঐ সকল নিয়মিত নামাযের অর্ন্তভুক্ত যেগুলো প্রতি বছর একবার করে আসে। যেমন, শাবানের শবে বরাতের নামায, রজবের নামায ইত্যাদি। এর মর্যাদা যদিও তারাবীহ এবং ঈদের নামাযের পর্যায়ের নয় তথাপি যেহেতু একাধিক ব্যক্তি বর্ণনা করেছেন আর বাইতুল মাকদিসের লোকজনও সর্ব সম্মত ভাবে নিয়মিতভাবে আদায় করে আসছে এমন কি তারা কাউকে এই নামায ছাড়ার অনুমতি দেয় না তাই এটার উল্লেখ করা ভাল মনে করলাম!!! (এহইয়া উলূমুদ্দীন প্রথম খণ্ড, ২০২ ও ২০৩)

অথচ মোটেও কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা তার কোন সাহাবী কখনো তা পড়েছেন বা পড়তে বলেছেন অথবা কোন সালফে সালেহীন থেকে কোন বর্ণনা পাওয়া যায়। (দেখুন: ইমাম ত্বরতুশীর লেখা আল হাওয়াদিস ওয়াল বিদা ১২২ পৃষ্ঠা)

আর এই এহইয়া উলূমুদ্দীন বইটি হল আমাদের সমাজে এই বিদয়াত এবং এ জাতীয় আরও বিদয়াত বিদআতী কার্যক্রম উৎপত্তির অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দ্বীনকে হেফাজত করুন। আমীন।

গ) সালাতুর রাগায়েবের ব্যাপারে ওলামাগণের মন্তব্য:

ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: সালাতুর রাগয়েবের কোন ভিত্তি নাই বরং এটি একটি বিদআত। সুতরাং একাকী কিংবা জামাতের সাথে পড়াকে মুস্তাহাব বলা যাবে না। বরং সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষভাবে শুধু জুমার রাতে নফল নামায পড়তে আর দিনের বেলা রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। সালাতুর রাগায়েবের ব্যাপারে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয় তা আলেমগণের সর্ব সম্মত মতানুসারে বানোয়াট। কোন সালাফে সালেহীন অথবা ইমাম আদৌ এটি উল্লেখ করেন নি। (মাজমূ ফতোয়া ২৩ খণ্ড ১৩২ পৃষ্ঠা)

ইমাম নওবী রহ.কে জিজ্ঞেস করা হয়, সালাতুর রাগায়েব ও শাবান মাসের পনের তারিখের দিবাগত রাতের নামাযের কোন ভিত্তি আছে?

তিনি বলেন: এই দুটি নামায নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা তার কোন সাহাবী, অথবা কোন ইমাম পড়েন নি এবং কেউ এদিকে ইঙ্গিতও করেন নি। অনুসরণ যোগ্য কেউই এমনটি করেন নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিংবা অনুকরণীয় কোন ব্যক্তি থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে এ ব্যাপারে কোন কিছুই পাওয়া যায় না। বরং তা পরবর্তী যুগে আবিষ্কার করা হয়েছে। সুতরাং এ নামাযগুলো নিকৃষ্ট বিদআত ও প্রত্যাখ্যান যোগ্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশুদ্ধ সহীহ সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন:

(( إياكم ومحدثات الأمور ، فإن كل محدثة بدعة ضلالة ))

“তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কৃত বিষয় সমূহ থেকে দূরে থাক। কারণ, প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয় গোমরাহী। (সুনান ইবনে মাজাহ) সহীহ বুখারী ও মুসলিম আয়েশা রা. হতে বর্ণিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

(( من أحدث في ديننا ما ليس منه فهو رد))

“যে ব্যক্তি দ্বীনের অর্ন্তভুক্ত নয় এমন নতুন জিনিষ চালু করল তা পরিত্যাজ্য। (বুখারী, অধ্যায়: সন্ধি-চুক্তি।)

আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে:

(( من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد ))

“যে ব্যক্তি এমন আমল করল যার ব্যাপারে আমার নির্দেশ নাই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম, অধ্যায়: বিচার-ফয়সালা(

প্রত্যেকের উচিৎ এই নামায থেকে দূরে থাকা এবং এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া। সেই সাথে এটাকে ঘৃণা যোগ্য ও নিকৃষ্ট মনে করে কঠিন ভাবে মানুষকে এ থেকে নিষেধ করা। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন:

 ((من رأى منكم منكراً فليغيره بيده ، فإن لم يستطع فبلسانه، فإن لم يستطع فبقلبه))

“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোন অন্যায় কাজ দেখে যেন হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়, যদি তা না পারে তবে মুখের কথা দ্বারা পরিবর্তন কর আর তাও না পারলে তার প্রতি  অন্তরে ঘৃণা পোষণ করে। (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান)

আলেমগণের কর্তব্য হল, এ বিদআত থেকে মানুষকে সাবধান করা এবং অন্যদের থেকে বেশী দূরত্ব বজায় রাখা কারণ তাদেরকে মানুষ অনুসরণ করে থাকে। সাধারণ মানুষের নিকট এটার প্রচার-প্রচারণা এবং তাদের সংশয়গুলো দেখে কেউ যেন ধোকায় না পড়ে যায়। বরং আমারদের তো অনুসরণ করতে হবে কেবল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার নির্দেশকে। যে ব্যাপারে তিনি নিষেধ বা সতর্ক করেছেন সেটা তে লিপ্ত হওয়া যাবে না।…আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদেরকে বিদয়াত ও ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ সব চেয়ে ভাল জানেন। (ইমাম ইবনে আব্দুল ইয এবং ইবনুস সালাহ এর মাঝে সংঘটিত বিতর্ক, পৃষ্ঠা ৪৫-৪৭)

ইবনুল কাইয়েম আল জাওযিয়া বলেন: অনুরূপভাবে রজব মাসের প্রথম শুক্রবারে সালাতুর রাগায়েব পড়ার ব্যাপারে হাদীসগুলো সব বানোয়াট ও আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মিথ্যা রোপ। (আল মানারুল মুনীফ: ৯০ পৃষ্ঠা)

সম্মানিত পাঠকের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, রজব মাসে প্রথম শুক্রবারে সালাতুর রাগায়েব নামে যে নামায পড়া তা নিকৃষ্ট বিদআত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে এটা চালু হয় নি। সাহবা, তাবেঈন এবং প্রসিদ্ধ কোন ইমাম এটাকে মুস্তাহাব বলেন নি। অথচ তারা ছিলেন কল্যাণকর ও ফযীলতপূর্ণ কাজে সব চেয়ে বেশী আগ্রহী। অনুরূপভাবে আমরা আরও দেখলাম, সমস- হাদীসের ইমামগণের মতৈক্য অনুসারে  এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসটি বানোয়া ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর মিথ্যা রোপ। সুতরাং যারা এ নামাযের ফযীলত বয়ান করে তাদের কোন যুক্তি বা দলীলই অবশিষ্ট থাকল না। আল্লাহই সব চেয়ে বেশী ভাল জানেন।

) শবে মেরাজ পালন করার বিদআত

     মেরাজ দিবস কিংবা শবে মেরাজ উদযাপন করা রজব মাসের অন্যতম বিদআত। জাহেলরা এই বিদআতকে ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে প্রতি বছর তা পালন করে যাচ্ছে। এরা রজব মাসের সাতাইশ তারিখকে শবে মেরাজ পালনের জন্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। এ উপলক্ষে এরা একটি নয় একাধিক বিদআত তৈরি করেছে। যেমন, শবে মেরাজ উপলক্ষে মসজিদ মসজিদে একত্রিত হওয়া, মসজিদে কিংবা মসজিদের মিনারে মিনারে মোমবাতি-আগরবাতি জ্বালানো, এ উপলক্ষে অর্থ অপচয় করা, কুরআন তিলাওয়াত বা জিকিরের জন্য একত্রিত হওয়া, মেরাজ দিবস উপলক্ষে মসজিদে বা বাইরে সভা-সেমিনার আয়োজন করে তাতে মিরাজের ঘটনা বয়ান করা ইত্যাদি। এগুলো সবই গোমরাহী এবং বাতিল কর্ম কাণ্ড। এ প্রসঙ্গে কুরআন-সুন্নাহতে নূন্যতম কিছু বর্ণিত হয় নি। তবে এ এভাবে দিবস পালন না করে যে কোন সময় মিরাজের ঘটনা বা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা দোষণীয় নয়।

ক) কোন রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল?

যে রাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল সেটি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ব যুগ থেকেই ওলামাগণের মাঝে মত পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন হাদীস না থাকায় আলেমগণ বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন: মিরাজের সময় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

কেউ বলেছেন, নবুওয়তের আগে। কিন্তু এটা একটি অপ্রচলিত মত। তবে যদি উদ্দেশ্য হয়, যে সেটা স্বপ্ন মারফত হয়েছিল সেটা ভিন্ন কথা।

অধিকাংশ আলেমগণের মত হল, তা হয়েছিল নবুওয়তের পরে। তবে নবুওয়তের পরে কখন সেটা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।

কেউ বলেছেন: হিজরতের এক বছর আগে। ইবনে সা’দ প্রমুখ এ মতের পক্ষে। ইমাম নওবী রহ. এই মতটির পক্ষে জোর দিয়ে বলেছেন। তবে ইবনে হাজাম এর পক্ষে আরও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলেন: এটাই সর্ব সম্মত মত। এই মতের আলোকে বলতে হয় মেরাজ হয়েছিল রবিউল আওয়াল মাসে।

কিন্তু তার কথা অগ্রহণ যোগ্য। কারণ, এটা সর্ব সম্মত মত নয়। বরং এক্ষেত্রে প্রচুর মতবিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিশটির অধিক মত পাওয়া যায়।

-ইবনুল জাওযী বলেন, হিজরতের আট মাস আগে মেরাজ হয়েছিল। এ মতানুসারে সেটা ছিল রজব মাসে।

-কেউ বলেন: হিজরতের ছয় মাস আগে। এ মত অনুযায়ী সেটা ছিল রামাযানে। এ পক্ষে মত দেন আবুর রাবী বিন সালেম।

-আরেকটি মত হল, হিজরতের এগার মাস আগে। এ পক্ষে দৃঢ়তার সাথে মত ব্যক্ত করেন, ইবরাহীম আল হারবী। তিনি বলেন: হিজরতের এক বছর আগে রবিউস সানীতে মিরাজ সংঘটিত হয়।

-কারো মতে, হিজরতের এক বছর তিন মাস আগে। ইবনে ফারিস এ মত পোষণ করেন।

এভাবে আরও অনেক মতামত পাওয়া যায়। কোন কোন মতে রবিউল আওয়াল মাসে, কোন মতে শাওয়াল মাসে, কোন মতে রামাযান মাসে, কোন মতে রজব মাসে।

আর তাই শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:

ইবনে রজব বলেন: রজব মাসে বড় বড় ঘটনা ঘটেছে মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু কোনটির পক্ষেই সহীহ দলীল নাই। বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রজবের প্রথম রাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, সাতাইশ বা পঁচিশ তারিখে নবুওয়ত প্রাপ্ত হয়েছেন অথচ এ সব ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল পাওয়া যায় না। (লাতাইফুল মায়ারেফ, ১৬৮ পৃষ্ঠা(

  আবু শামাহ বলেন: গল্পকারেরা বলে থাকে যে, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা ঘটেছিল রজব মাসে। কিন্তু ইলমে জারহ ওয়াত তাদীল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আলেমগণের মতে এটা ডাহা মিথ্যা। (আল বায়িস: ১৭১)

খ) শবে মিরাজ পালন করার বিধান:

সালফে সালেহীনগণ এ মর্মে একমত যে, ইসলামী শরীয়তে অনুমোদিত দিন ছাড়া অন্য কোন দিবস উদযাপন করা বা আনন্দ-উৎসব পালন করা বিদআত। কারণ, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

(( من أحدث في ديننا ما ليس منه فهو رد))

“যে ব্যক্তি দ্বীনের অর্ন্তভুক্ত নয় এমন নতুন জিনিষ চালু করল তা পরিত্যাজ্য। (বুখারী, অধ্যায়: সন্ধি-চুক্তি।)

আর সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে:

(( من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد ))

“যে ব্যক্তি এমন আমল করল যার ব্যাপারে আমার নির্দেশ নাই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম, অধ্যায়: বিচার-ফয়সালা)

সুতরাং মিরাজ দিবস অথবা শবে মেরাজ পালন করা দ্বীনের মধ্যে সৃষ্ট বিদআতের অর্ন্তভূক্ত সাহাবীগণ, তাবেঈনগণ বা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী সালফে সালেহীনগণ তা পালন করেন নি। অথচ সকল ভাল কাজে তারা ছিলেন আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগামী।

ইবনুল কাইয়েম জাওযিয়া রহ. বলেন:

ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: পূর্ববর্তী যুগে এমন কোন মুসলমান পাওয়া যাবে না যে শবে মেরাজকে অন্য কোন রাতের উপর মর্যাদা দিয়েছে। বিশেষ করে শবে কদরের চেয়ে উত্তম মনে করেছে এমন কেউ ছিল না। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাদের একনিষ্ঠ অনুগামী তাবেঈনগণ এ রাতকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন কিছু করতেন না এমনকি তা আলাদাভাবে স্মরণও করতেন না। যার কারণে জানাও যায় না যে, সে রাতটি কোনটি।

নি:সন্দেহে ইসরা ও মিরাজ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। কিন্তু এজন্য এর মিরাজের স্থান-কালকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত করার বৈধ নয়। এমনকি যে হেরা পর্বতে ওহী নাযিলের সূচনা হয়েছিল এবং নবুওয়তের আগে সেখানে তিনি নিয়মিত যেতেন নবুওয়ত লাভের পর মক্কায় অবস্থান কালে তিনি কিংবা তাঁর কোন সাহাবী সেখানে কোন দিন যান নি। তারা ওহী নাজিলের দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ কোন ইবাদত-বন্দেগী করেন নি বা সেই স্থান বা দিন উপলক্ষে বিশেষ কিছুই করেন নি।

যারা এ জাতীয় দিন বা সময়ে বিশেষ কিছু এবাদত করতে চায় তারা ঐ আহলে কিতাবদের মত যারা ঈসা আলাইহিস সালাম এর জন্ম দিবস (Chisthomas) বা তাদের দীক্ষাদান অনুষ্ঠান (Baptism) পালন ইত্যাদি পালন করে।

উমর ইবনুল খাত্তাব দেখলেন কিছু লোক একটা জায়গায় নামায পড়ার জন্য হুড়াহুড়ি করছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? তারা বলল, এখানে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামায পড়েছিলেন। তিনি বললেন, তোমরা কি তোমাদের নবীদের স্মৃতি স্থলগুলোকে সাজদার স্থান বানাতে চাও? তোমাদের পূর্ববর্তী জমানার লোকেরা এ সব করতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে এসে যদি তোমাদের কারো নামাযের সময় হয় তবে সে যেন নামায পড়ে অন্যথায় সামনে অগ্রসর হয়। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, ২য় খণ্ড, ৩৭৬, ৩৭৭)

ইবনুল হাজ্জ বলেন:

“রজব মাসে যে সকল বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে সগুলোর মধ্যে সাতাইশ তারিখের লাইলাতুল মিরাজের রাত অন্যতম।”(আল মাদখাল, ১ম খণ্ড, ২৯৪পৃষ্ঠা)

পরিশেষে বলব, যেহেতু রজব মাসে নফল নামায, রোযা করা, মসজিদ, ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট দোকান-পাট ইত্যাদি সাজানো, সেগুলোকে আলোক সজ্জা করা কিংবা ছাব্বিশ তারিখের দিবাগত রাত তথা সাতাইশে রজবকে শবে মিরাজ নির্ধারণ করে তাতে রাত জেগে ইবাদত করার ব্যাপারে কোন গ্রহনযোগ্য প্রমাণ নাই। তাই আমাদের কর্তব্য হবে সেগুলো থেকে দূরে থাকা। অন্যথায় আমরা বিদয়াত করার অপরাধে আল্লাহ তায়ালার দরবারে গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হব। অবশ্য কোন ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে কিছু নফল রোযা রাখে সে এমাসেও সেই ধারাবাহিকতা অনুযায়ী এ মাসে রোযা রাখতে পারে, শেষ রাতে উঠে যদি নফল নামাযের অভ্যাস থাকে তবে তবে এ মাসের রাতগুলিতেও নামায পড়তে পারে।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সকল অবস্থায় তাওহীদ ও সুন্নাহর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন এবং শিরক ও বিদয়াত থেকে হেফাজত করুন। আমীন।

উৎস: এ প্রবন্ধটির অধিকাংশ তথ্য অনুবাদ করা হয়েছে البدع الحولية কিতাব থেকে।

Share: