এ কথা অনস্বীকার্য যে, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বর্তমান সময়ে আধুনিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিরাট একটা অংশ দখল করে নিয়েছে। এর দ্বারা যেমন মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপকৃত হচ্ছে তেমনি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনেক সময় এগুলোর মাধ্যম মানসিক অস্থিরতা, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, দাম্পত্য কলহ, ধর্মীয় বাদানুবাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা এবং আইন বিরোধী ও অপরাধ মূলক কার্যক্রম বাড়ছে। এর বিপরীতে অনেক মানুষ এগুলোকে লেখাপড়া, জ্ঞানার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রচার-প্রসার, বিষয় ভিত্তিক কোর্স ও টিউটোরিয়াল, বিভিন্ন সমস্যা ও অসঙ্গতি দূরীকরণে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, ইসলাম প্রচার, বিশেষজ্ঞদের নিকট থেকে ব্যক্তিগত, রোগ-ব্যাধি, ইসলামি বা বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও পরামর্শ গ্রহণ, কল্যাণমুখী সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।
এর অর্থ হল, এসব সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোকিত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দুটি দিক আছে। এখন ব্যবহারকারী কি আলোকিত পথে হাঁটবে না কি অন্ধকার অলিগলিতে ঘুরে নিজের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসবে সেটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। কিন্তু একজন আখিরাতের মুক্তিকামী মুসলিম হিসেবে আমাদের কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করা উচিৎ?
উত্তর হল, অবশ্যই উপকারী ও কল্যাণকর কাজে এগুলো ব্যবহার করতে হবে। কোনভাবেই হারাম ও ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
❑ সোশ্যাল মিডিয়ায় হারাম ও ক্ষতিকর কার্যক্রমের কিছু উদাহরণ:
● বেপর্দা নারীর ছবি আপলোড করা।
● অশ্লীলতার বিস্তার ঘটানো।
● স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত রোমান্স-খুনসুটির ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা।
● গোপন গুনাহের কাজ শেয়ার করা।
● কাউকে হেয় ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা কারো প্রতি অন্যায়ভাবে ঘৃণা ছড়ানো।
● শরিয়ত বহির্ভূত গিবত ও সমালোচনা করা।
● কাউকে গালাগালি, অপমান ও অপদস্ত করা।
● গর্ব-অহংকার প্রকাশ করা।
● কাউকে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করা।
● নির্ভরযোগ্য উৎস ছাড়া ভুয়া তথ্য প্রচার করা বা কারো প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা।
● ধর্মীয় বা রাজনৈতিক দাঙ্গা লাগানোর উদ্দেশ্যে উস্কানি মূলক তথ্য, ফেইক ছবি ইত্যাদি প্রচার করা।
● জাল-যঈফ হাদিস, বাতিল, কুসংস্কারপূর্ণ ও দলিল বহির্ভূত কথাবার্তা প্রচার।
● কারো একান্ত ব্যক্তিগত দোষত্রুটি ও গুনাহের কাজ সংক্রান্ত ছবি, ভিডিও বা স্ক্রিনশট শেয়ার করা।
● ক্ষতিকারক বা কুপ্রভাব সৃষ্টি করে এমন কন্টেন্ট প্রকাশ করা।
● আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম বা ইসলামি বিধিবিধানকে কটাক্ষ ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। ঠিক একইভাবে অন্য ধর্মের দেবদেবীকে গালাগালি করা বা সেগুলোর প্রতি অশালীন বাক্য ব্যবহার করা ইত্যাদি।
এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন হারাম ও গুনাহের কাজ তেমনি সামাজিকভাবেও নিন্দনীয় আবার এগুলোর মধ্যে কিছু বিষয় দেশের ডিজিটাল আইনেও দণ্ডনীয় অপরাধও বটে।
❑ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি শেয়ার করা:
সোশ্যাল মিডিয়ায় বিনা প্রয়োজনে ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়াদি, বাড়ির কোথায় কি আছে, ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর তথ্য ইত্যাদি পোস্ট করা উচিত নয়। কারণ অনেক সময়ে এসব কারণে ফেতনা সৃষ্টি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনলাইনে সাইবার দুর্বৃত্তরা ফাঁদ পেতে বসে থাকে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করা হলে তা কাজে লাগিয়ে ক্ষতি করে বসতে পারে তারা। ফেসবুকে তাই কোনও কিছু শেয়ার করা আগে কিছুটা মেধা খাটাতে পারেন।
আর গুরুত্বপূর্ণ বা উপকারী নয় এমন বিষয় পোস্ট করা ইসলামের দৃষ্টিতে অনর্থক কাজ এবং অযথা সময়, শ্রম, অর্থ ও মেধা অপচয়ের শামিল। ইসলামের সৌন্দর্য হল, অযথা ও অনর্থক কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা। যেমন:
✪ হাদিসে এসেছে, আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيهِ
“অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করা ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্যময় দিক।” (তিরমিযী-হাসান)
✪ তিনি আরও বলন,
احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ
“যে কাজে তোমার উপকার আছে তার প্রতি আগ্রহী হও।” (মুসলিম, মিশকাত হা/৫২৯৮)।
✪ ইসলামে অর্থ-সম্পদ, যৌবন ও সময়কে উপকারী কাজে লাগানো এবং অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব এসেছে। যেমন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন,
اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ : شَبَابَكَ قَبْلَ هَرَمِكَ ، وَصِحَّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ ، وَغِنَاكَ قَبْلَ فَقْرِكَ ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ
তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিস আসার আগে গনিমতের অমূল্য সম্পদ মনে করো:
● ১) যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে।
● ২) সুস্থতাকে অসুস্থ হওয়ার আগে।
● ৩) সচ্ছলতাকে দরিদ্রতা আসার আগে।
● ৪) অবসর সময়কে ব্যস্ততা আসার আগে।
● ৫) এবং জীবনকে মৃত্যু আসার আগে।”
(মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৮ম খণ্ড, ৮ম অধ্যায় ১২৭ পৃষ্ঠা। আল্লামা আলবানি হাদিসটি সহীহ বলেছেন। দ্রষ্টব্য: সহিহুত তারগিব/৩৩৫৫)
যে সব পোস্টের মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হবে, সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হবে, দুনিয়া বা আখিরাতের কাজে লাগবে, মানব সেবা, দেশের উন্নয়ন, চারিত্রিক উৎকর্ষতা ইত্যাদিতে অনুপ্রাণিত হবে এবং মন্দ পরিত্যাগে উৎসাহিত হবে সে সব বিষয়াদি প্রকাশ করায় দোষ নাই।
অনুরূপভাবে কমেন্ট, শেয়ার, ওয়াচ পার্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সতর্কতা জরুরি।
কারণ হয়ত একটি অসত্য কথা, গালাগালি, গিবত ও অপবাদ মূলক কমেন্টের কারণে আখিরাতে মহাবিপদের দিন আল্লাহর কাঠগড়ায় বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। আর একটি জাল হাদিস, সহিহ আকিদা বিরোধী কথা কিংবা খারাপ, অশ্লীল ও গুনাহের বিষয় শেয়ার করার কারণে কিয়ামত পর্যন্ত গুনাহে জারিয়া চালু হয়ে যাবে-যা মারা যাওয়ার পরও আমলনামায় জমতেই থাকবে। কারণ যত মানুষ আপনার শেয়ার কৃত পোস্ট থেকে ভুল তথ্য শিখবে বা এ কারণে অন্যায় ও গুনাহে লিপ্ত হবে তার একটা গুনাহ আপনার আমলনামায় জমা হবে। সুতরাং সাধু সাবধান!
পরিশেষে কথা হল, সোশ্যাল মিডিয়ার পেছনে আমাদের এত বেশি সময় অপচয় করা ও নেশার মত পেছনে লেগে থাকা উচিৎ নয় যে, এ কারণে ইবাদত-বন্দেগিতে অলসতা সৃষ্টি হয়, বাবা-মা, ভাই-বোন ইত্যাদি রক্ত সম্পর্কীয় বন্ধন ও নিকটাত্মীয়দের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়, সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, ইসলামি জ্ঞানচর্চা এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা প্রদর্শন করা হয়। অন্যথায় তা দুনিয়া ও আখিরাতে
আমাদের বিরাট আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ ক্ষমা করুন। আমিন।
দুআ করি, মহান আল্লাহ আমাদেরকে উপকারী কথা ও কাজ করার তওফিক দান করুন এবং ক্ষতিকর সব কিছু থেকে দূরে রাখুন। আমিন।
▬▬▬❖◉❖▬▬▬▬
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব।