অন্তর কঠিন হওয়ার ক্ষতি, কারণ এবং তা নরম করার ১২ উপায়

মুমিনের বৈশিষ্ট হল, সে হবে কোমল হৃদয়ের অধিকারী, দয়ালু ও সহজ-সরল। আল্লাহ তাআলা কুরআনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মানবিক গুণাবলীর প্রশংসা করেছেন এভাবে:
فَبِمَا رَحْمَةٍ مِّنَ اللَّـهِ لِنتَ لَهُمْ ۖ وَلَوْ كُنتَ فَظًّا غَلِيظَ الْقَلْبِ لَانفَضُّوا مِنْ حَوْلِكَ
“আল্লাহর দয়ায় আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রুক্ষ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো” (সূরা আল-ই ইমরান: ১৫৯)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমিনের বৈশিষ্ট উল্লেখ করে বলেন:
حُرِّمَ عَلَى النَّارِ كُلُّ هَيِّنٍ لَيِّنٍ سَهْلٍ قَرِيبٍ مِنْ النَّاسِ
“জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম যে ব্যক্তি শান্ত-শিষ্ট, নম্র, সহজ-সরল চরিত্রের অধিকারী হবে আর মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করবে।” (সহিহুল জামে হা/৩১৩৫-শাইখ আলবানী)।
এ ছাড়াও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তর কঠিন হওয়া থেকে আশ্রয় চেয়ে দুআ করেছেন। (পোস্টের শেষে এ সংক্রান্ত দুটি দুআ উল্লেখ করা হয়েছে)
এ সংক্রান্ত আরও বহু আয়াত ও হাদিস বিদ্যমান রয়েছে।

◈◉ অন্তর কঠিন হওয়ার ক্ষতিকর দিক সমূহ:

বিশেষজ্ঞ আলেমগণ অন্তর কঠিন হওয়ার অনেক ক্ষতিকর দিক উল্লেখ করেছেন। সেগুলো থেকে কতিপয় দিক উল্লেখ করা হল:

১) অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া একটি বড় ধরণের রোগ। আমরা আমাদের শারীরিক রোগ-ব্যাধি নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন ও পেরেশান থাকি ততটাই অবহেলা করি অন্তরের রোগ নিয়ে। অথচ এটি শারীরিক রোগ-ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক ও ভয়াবহ।
২) অন্তর কঠিন হওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক হল, এতে অন্তর থেকে আল্লাহর ভয় উঠে যায়। তখন কঠিন অন্তরের মানুষের কাছে পাপ ও অন্যায়-অপকর্মকে পাপ ও অপরাধ বলে মনে হয় না।
৩) শক্ত হৃদয়ে আল্লাহর হেদায়েতের আলো প্রবেশ করে না। আর হেদায়েতের আলো না থাকার কারণে সে পথভ্রষ্টতার ঘুটঘুটে অন্ধকারে উদভ্রান্তের মত ঘুরতে থাকে।
৪) হৃদয়ে মুনাফেকি, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ইত্যাদি রোগ-ব্যাধি বাসা বাধে। যার কারণে কুফরি ও মুনাফেকির দুর্গন্ধময় পঙ্কিলতায় ডুবে থাকলেও তার মধ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
৫) কবরের ভয়াবহ বিপদাপদ, হাশরের ময়দানের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি এবং জাহান্নামের মর্মন্তুদ শাস্তি কথা শুনেও পাষাণ হৃদয় লোকের দু চোখ অশ্রু বিগলিত হয় না বা অন্তর কেঁপে উঠে না।
৬) কঠিন অন্তরের মানুষের মনে মৃত্যু সম্পর্কিত উপদেশ ও ওয়াজ-নসিহত প্রভাব ফেলে না।
৭) মৃত্যু কিংবা জানাজা দেখেও তার মনে দাগ কাটে না।
৮) কাঁধে লাশ বহন করলে বা লাশকে কবরের গর্তে রাখতে দেখেও তার কোন মনের মধ্যে ভাবান্তর ঘটে না।
৯) গোরস্থান দিয়ে হেঁটে গেলে তার কাছে মনে হয় যে, কতগুলো ইট-পাথরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে!!
১০) যখন অন্তর শক্ত হয়ে যায় তখন আল্লাহ নিদর্শন দেখে অন্তর প্রকম্পিত হয় না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্যোগ, আল্লাহর আজব-গজব স্বচক্ষে দেখেও তার হৃদয় বিগলিত হয় না।
১১) মন থেকে দয়া-মায়া উঠে যায়। যার কারণে পাষাণ হৃদয়ের মানুষ পশু-পাখি, নারী, শিশু ও দুর্বল মানুষের উপর অত্যাচার করে-নির্মম নির্যাতন করে এবং তাদের অধিকার নষ্ট করে।
মোটকথা, মনটা পাথরের মত এতটাই শক্ত হয় যে, তাতে কোন কিছুই প্রভাব সৃষ্টি করে না। আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের সমালোচনা করে বলেন:
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَالْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةً
“অতঃপর এ ঘটনা (তথা বিস্ময়কর মুজিযা দেখার পরে) তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তা পাথরের মত অথবা তদপেক্ষাও কঠিন।” (সূরা বাকারা: ৭৪)

◈◉ কী কারণে একজন মুমিন এ রোগে আক্রান্ত হয়?

এবার জানার জেনে নেয়া যাক, একজন ইমানদার কী কী কারণে এই রোগে আক্রান্ত হয়।

নিম্নোক্ত কারণে একজন ইমানদারের অন্তর কঠিন হয়ে যায়:

১) আল্লাহর জিকির থেকে বিমুখ থাকা।
২) ফজর ইবাদতের ব্যাপারে অবহেলা করা।
২) গুনাহর কাজ করা।
৩) দীনের জ্ঞান অন্বেষণ না করা।
৪) কু প্রবৃত্তির অনুসরণ করা এবং সত্য গ্রহণ না কর।
৫) অহংকার এবং খারাপ চরিত্র।
৬) দুনিয়ার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়া।
৭) বিদআতিদের বই-পুস্তক পড়া (বা বক্তৃতা শোনা) এবং সেগুলো দ্বারা প্রভাবিত হওয়া।
৮) প্রয়োজন অতিরিক্ত কথা বলা, খাওয়া, ঘুমানো, হাসাহাসি করা, মানুষের সাথে উঠা-বসা করা এবং অনর্থক কাজে ব্যস্ত থাকা।

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অন্তর এমন শক্ত হয়ে যাওয়া থেকে হেফাজত করুন যার কারণে আমরা হেদায়েতের অমৃত সুধা পান করা হতে বঞ্চিত হই। আল্লাহই একমাত্র অন্তরের পরিবর্তন কারী।
হে আল্লাহ, তুমি আমাদের অন্তরগুলোকে তোমার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। আমীন।
(শাইখ খালিদ বিন সঊদ আল বুলাইহিদ এর লেখা থেকে উপরোক্ত ৮টি পয়েন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে)

◈◉ অন্তর নরম করার ১২ উপায়:

প্রিয় বন্ধুগণ, অন্তর শক্ত হয়ে যাওয়ার ক্ষতিকর দিক এবং কারণ সমূহ জানার পর এখন জানা প্রয়োজন যে, কিভাবে আমাদের অন্তরকে নরম করতে পারি। কেননা, মুক্তি প্রত্যাশী ইমানদারের জন্য তা অতীব জরুরি।

নিম্নোক্ত বিষয়গুলো আমাদের অন্তর সমূহে মনের পাষণ্ডতা ও কাঠিন্যকে দূর করে এবং মনকে নরম-কোমল ও দয়ালু হতে সাহায্য করে:

১) মহান আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা এবং তাঁর বিশাল ক্ষমতা, অগণিত নেয়ামতরাজি, অফুরন্ত দয়া, ভয়াবহ শাস্তি ইত্যাদি স্মরণ করে সকাল-সন্ধ্যা ও জীবনের প্রতি মুহূর্তে তার জিকির করা এবং তার আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।

২) কুরআন তিলাওয়াত করা, বুঝে পড়া, কুরআনের হুকুম-আহকাম, নিদর্শনাবলী নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা এবং তদনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা।

৩) আখিরাতের কথা চিন্তা করা, জান্নাতের সুখ-সম্ভার, হাশরের ময়দান ও জাহান্নামের ভয়াবহ চিত্র মনের ক্যানভাসে জাগ্রত করা এবং মৃত্যু ও কবরের শাস্তি নিয়ে ভাবা।

৪) রোগ-শোক ও দরিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত, নানা কষ্টে নিপতিত এবং বিভিন্ন বিপদগ্রস্ত মানুষদেরকে দেখা এবং নিজের অবস্থা বিবেচনা করে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা পোষণ করা।

৫) অধিক পরিমাণে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা: মৃত্যুর স্মরণ পাপীকে পাপাচার থেকে নিবৃত করে এবং কঠিন অন্তরের মানুষের অন্তর নরম করে দেয়।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَادِمِ اللَّذَّاتِ يَعْنِي الْمَوْتِ
“তোমরা অধিক পরিমাণে আনন্দ বিধ্বংসী বিষয় তথা মৃত্যুর কথা স্মরণ কর।” (সুনান তিরমিযী, সহীহুল জামে, হাদিস নং ১২১০)

৬) কবর যিয়ারত করা: মৃত্যুর কথা স্মরণ করাতে সবচেয়ে বেশী কার্যকর উপায় হল, কবর যিয়ারত করা। এতে এক দিকে যেমন নিজের মৃত্যু ও আখিরাতের কথা স্মরণ হয় অন্য দিকে নিজের দুর্বলতা, অন্তিম পরিস্থিতি ও পরিণতির কথা মনে জাগ্রত হয় এবং অন্তর বিগলিত হয়।

৭) মারাত্মকভাবে আহত, দুরারোগ্য ব্যাধিতে পতিত, শয্যাশায়ী ও বিভিন্ন বিপদাপদে পড়ে সর্বস্বান্ত মানুষগুলোকে দেখতে যাওয়া।

৮) এতিম ও অসহায় মানুষের সাহায্যে কাজ করা।

৯) আমলদার ও তাকওয়াবান আলেমদের সাথে সংশ্রব রাখা এবং খারাপ ও পাপী লোকদের সংশ্রব এড়িয়ে চলা।

১০) অতিরিক্ত খাওয়া, ঘুম ও কথা এবং মাত্রাতিরিক্ত লোকজনের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা।

১১) অন্তর নরম করে এমন বই-পুস্তক পড়া পড়া বা বড় আলেমদের বক্তৃতা শ্রবণ করা। যেমন: কবরের আযাব, হাশরের ময়দানের বিভিষিকাময় চিত্র, জাহান্নামের বিবরণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের দ্বীনের জন্য অবর্ণনীয় ত্যাগ-তিতীক্ষা এবং তাদের যুহুদ বা অনাড়ম্বর জীবন কাহিনী ইত্যাদি।

১২) সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে অন্তরের কাঠিন্য থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তরের নিষ্ঠুরতা থেকে আল্লাহ নিকট আশ্রয় চাইতেন এভাবে:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ الْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ وَالْهَرَمِ وَالْقَسْوَةِ وَالْغَفْلَةِ وَالْعَيْلَةِ وَالذِّلَّةِ وَالْمَسْكَنَةِ
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট অক্ষমতা, অলসতা, কাপুরুষতা, কৃপণতা, বার্ধক্য, নিষ্ঠুরতা, গাফিলতি, অভাব-অনটন, হীনতা, নিঃস্বতা থেকে আশ্রয় চাই।” (সহীহ জামিউস সগীর)
তিনি আরও বলতেন:
لَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لاَ يَنْفَعُ وَمِنْ قَلْبٍ لاَ يَخْشَعُ وَمِنْ نَفْسٍ لاَ تَشْبَعُ وَمِنْ دَعْوَةٍ لاَ يُسْتَجَابُ لَهَا
“হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই এমন ‘জ্ঞান থেকে যা উপকার দেয় না, এমন হৃদয় থেকে যা বিনম্র হয় না, এমন আত্মা থেকে যা পরিতৃপ্ত হয় না এবং এমন দোয়া থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই যা কবুল হয় না।”(মুসলিম ২৭২২)

পরিশেষে দুআ করি, মহান আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের অন্তরকে কঠিন হওয়া থেকে হেফাজত করেন এবং অন্তরকে এমন নরম করেন যার মাধ্যমে আমরা তাঁর আনুগত্যের উপর পরিচালিত হতে পারি। আমীন।
——————————
গ্রন্থনায়:
গ্রন্থনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব