কবর পাকা করা কি জায়েজ?

সকল প্রশংসা একমাত্র মহান রাব্বুল আলামীনের জন্যে, যিনি জগত সমূহের একচ্ছত্র মালিক। অজস্র শান্তির ধারা বর্ষিত হোক নবীকুল শিরোমনী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ এবং তাঁর সকল অনুসারীদের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কবর পাকা করা, চুনকাম করা, কবর উঁচু করার প্রবনতা দেখা যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্থানে এ ধরণের কর্মকান্ড খুবই বেশী। প্রতিনিয়ত তা বেড়েই চলছে। মানুষের ধারণা হল এ সমস্ত কাজ শরীয়ত সম্মত এবং এতে ছোয়াব রয়েছে। তাই দেখা যায় করবস্থানে, রাস্তার আশে-পাশে, চৌরাস্তায় ও বটগাছ তলায় কবর পাকা করে, চুনকাম করে, তাতে উন্নত নেমপ্লেট ব্যবহার করে মৃত্যু ব্যক্তির জন্ম, মৃত্যু তারিখ ও বিভিন্ন বানী লিখে রাখা হয়। এ জাতীয় সকল কাজ শরীয়ত বিরোধী। শরীয়তে এর হুকুম হল বিদআত। কারণ এ গুলো করার পিছনে ইসলামী শরীয়তে কোন দলীল নেই, বরং এ গুলো থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে শরীয়ত কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিশিষ্ট সাহাবী জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন,
نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يُجَصَّصَ الْقَبْرُ وَأَنْ يُقْعَدَ عَلَيْهِ وَأَنْ يُبْنَى عَلَيْهِ.
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরে চুন কাম করা, তার উপর বসা এবং তার উপর বিল্ডিং নির্মান করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণ হল যে, কবরে প্লাস্টার লাগানো, চুন কাম করা, পাকা করা, কবরের উপর বিল্ডিং ও গম্বুজ নির্মাণ করা কঠোর ভাবে নিষেধ। তারা বলে থাকেন আমরা সৌন্দর্য প্রকাশ ও কবরকে হেফাযতের জন্য এ গুলো করে থাকি। জেনে রাখুন সোন্দর্য প্রকাশের জন্য হোক, মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য হোক কিংবা হেফাযতের জন্য হোক, তা শরীয়তে জঘন্যতম বিদআত। এ গুলো করার পিছনে কোন দলীল নেই।
বর্তমান কালে অধিকাংশ মুসলিম সমাজ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চলছে। রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিষেধ করেছেন, তারা তাতেই লিপ্ত হয়েছে। এতে করে তারা বড় শির্কে লিপ্ত হয়েছে। কবরে উপর নির্মাণ করছে মাসজিদ ও গম্বুজ। কবরকে পরিণত করছে মাযারে ও যিয়ারতের স্থানে। সেখানে তারা পশু যবেহ করা ও কবর বাসীর কাছে চাওয়া-পাওয়া, নযর-নেওয়াজ ইত্যাদি সকল প্রকার ইবাদতে লিপ্ত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ওয়া সাল্লাম এর যুগে বদর, উহুদ, খন্দক, তাবুক যুদ্ধ ছাড়াও যে সকল সাহাবী শহীদ হয়েছেন অথবা মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁদের কারও কবর উচু করা হয় নাই। তাঁদের কারও কবর পাকা ও চুনকামও করা হয়নি এবং তাতে নামও লিখা হয়নি। তাঁদের কারও কবর মোজাইক অথবা পাথর দ্বারা বাঁধানো হয়নি বরং এ সকল কাজ যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, তাঁর পরে স্বর্ণ যুগের খোলাফায়ে রাশেদীনগণও কঠোর হস্তে দমন করেছেন। এর একটি উজ্জল উদাহরণ হল, প্রখ্যাত তাবেয়ী আবুল হাইয়্যাজ আল আসাদী বলেন, আমাকে আলী (রাঃ) বললেনঃ
أَلاَّ أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِى عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ لاَ تَدَعَ تِمْثَالاً إِلاَّ طَمَسْتَهُ وَلاَ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلاَّ سَوَّيْتَ
“তোমাকে কি আমি এমন একটি কাজ দিয়ে পাঠাবো না যে কাজ দিয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠিয়েছিলেন? তা হল কোন প্রতিকৃতি ও মূর্তি পেলে তাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলবে, আর কোন উচুঁ কবর পরিলক্ষিত হলে তা সাধারণ কবরের সমপরিমান করে দিবে।” (মুসলিম)
আকীদাগত ক্ষতিঃ আমরা যদি দৃষ্টি নিক্ষেপ করি তবে দেখতে পাব এসব উচুঁ উচুঁ কবরের কারণে অধিকাংশ লোকের আকীদাহ বিপন্ন হতে চলছে। দেখুন আমাদের দেশে বিভিন্ন এলাকাতে কবর উচুঁ করা হয়েছে, তাতে মূল্যবান মোজাইক পাথর দ্বারা সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে,সুন্দরভাবে বাঁধাই করা হয়েছে, বিভিন্ন রংবেরং এর বাতিও লটকানো হয়েছে। যা ইসলামী শরীয়ত আদৌ সমর্থন করে না। এসব কবরের কাছে নারী-পুরুষের আড্ডা বসে, তারা সেখানে কবরকে সামনে করে দীর্ঘ সময় তসবীহ জপে, কান্না-কাটি করে, আর্জি পেশ করে, মনের কাকুতি-মিনতি নিয়ে সকল সমস্যার কথা তুলে ধরে, আবার মাঝে মাঝে সেজদায় লুটিয়ে পড়ে। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের কাছে বা কবরের দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে নিষেধ করেছেন। মুসলমানরা তাঁর নিষেধ অমান্য করে কবরকে নামাযের স্থানে পরিণত করেছে। তিনি কবরকে মাসজিদ বানাতে নিষেধ করেছেন। তারা তাকে মাসজিদ বানিয়েছে। তিনি কবরে বাতি জ্বালাতে নিষেধ করেছেন। তারা বাতি জ্বালিয়ে প্রচুর অর্থ অপচয় করছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের পাশে ওরশ-উৎসব করতে নিষেধ করেছেন এরা প্রতি বছর ঈদের মত ধুমধামের সাথে ওরশ অনুষ্ঠান পালন করে চলছে। কখন কখনও আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার পরিবর্তে আল্লাহর যিকির-আযকারের ন্যায় যিকর করে। অনেক সূফী বিদআতী ভন্ড মুরীদরা নামায বাদ দিয়ে সেখানে সময় অতিবাহিত করে। আবার নামায পড়া অবস্থায় পীরের ধ্যান করে থাকে। আরও দেখা যায় এ ধরণের কবর যা রাস্তার পার্শ্বে অবস্থিত সেখান দিয়ে পথচারী পথ চলার সময় বিদআতী নিয়মে সালাম করে এবং বুযুর্গের অধিক তা’যিমের জন্য কবরে চুমু খায়, কবরের মাটি গায়ে মাখে, কখনও তওয়াফ করে, সাথে সাথে কিছু অর্থও দান করে যায়। অথচ দান করা, নযর-মানত করা, প্রার্থনা করা, দুআ করা, সেজদাহ করা, যিকির করা, আর্জি পেশ করা ইত্যাদি সকল কিছু হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যে। এ সম্পর্কে কুরআনে ও হাদীসে যথেষ্ট আলোচনা করা হয়েছে, যাতে রয়েছে মানব জীবনের পূর্ণ দিক নির্দেশনা । আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
“আপনি বলুন, নিশ্চয় আমার নামায, আমার হজ্ব ও কুরবানী, আমার জীবন-মরণ একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য যিনি জগত সমূহের প্রতিপালক।” (সূরা আনআমঃ ১৬২)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
إِذَا سَأَلْتَ فَاسْأَلِ اللَّهَ وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ
“কোন কিছু চাওয়ার হলে আল্লাহর কাছে চাইবে এবং সাহায্য চাইলে একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য চাইবে।” (তিরমিযী)
সুপ্রিয় পাঠক বন্ধুগণ! কবরের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন? আর এরা করছে কি? এরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের সম্পূর্ণ বিপরীত পথে চলছে। তাদের বিদআতী কাজ-কর্মের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না।
আরও লক্ষ্য করুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে কেন কবর যিয়ারত করতে বলেছেন? আমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে বলেছেন যাতে আমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং যাতে কবরবাসীর পাশে গিয়ে কবরবাসীর জন্য দুআ করি, তাদের জন্য আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি। আর বর্তমান যুগের মুসলমানেরা কবর যিয়ারতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সম্পূর্ণ পাল্টিয়ে ফেলেছে। তাদের উদ্দেশ্য হল সেখানে গিয়ে শির্কে লিপ্ত হওয়া। কবরবাসীর কাছে দুআ করা। সমস্যার কথা তুলে ধরা। তার উসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা, প্রয়োজন পূরণের আবেদন করা ইত্যাদি। এধরণের শিরক ও বিদআত কোথা থেকে চালু হয়েছে?
এ ধরণের শিরক ও জঘন্যতম বিদআত চালু হয়েছে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের দ্বারা। এগুলো হল ইহুদী-খ্রীষ্টনদের রীতি। খ্রীষ্টানরা ঈসা ও মরিয়ম এবং ক্রশের পূজা করে থাকে। ইউরোপীয়ান, আমেরিকান এবং রাশিয়ানরা তাদের নেতাদের প্রতিমূর্তির পূজা করে এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের সামনে মাথা নত করে। আর তাদের অনুকরণে অনেক মুসলিম উক্ত শিরক ও বিদআতে লিপ্ত হয়েছে। যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। ইসলাম পূর্ব লোকেরা তাদের নবীদের কবরকে মাসজিদ বানিয়ে নিয়ে সেখানে ইবাদত করত। এ কথা হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্কার ভাবে বলে দিয়েছেনঃ
أَلَا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلَا فَلَا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ
“জেনে রাখা উচিৎ যে, তোমাদের পূর্বের লোকেরা তাদের নবীদের কবরসমূহকে মাসজিদে পরিণত করত। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে মাসজিদে পরিণত কর না। আমি তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছি।” (মুসলিম)
কবরকে মাসজিদে পরিণত করার অর্থ হল কবরের কাছে নামায আদায় করা। যদিও তার উপর মাসজিদ নির্মাণ করা হয়নি। মূলতঃ নামাযের জন্য কোন স্থানে গমণ করাই উক্ত স্থানকে মাসজিদে রূপান্তরিত করার শামিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু ইহুদী-খ্রীষ্টানদের প্রতি লা’নত করেছেন, কেননা তারা তাদের নবীদের কবরকে মাসজিদ বানিয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর কি উঁচু করা হয়েছে? এর উত্তর হল, না। অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবর উঁচু করা হয় নি। তার কবর বাঁধানোও হয়নি, তার কবরকে মাযারও বানানোও হয়নি, কোন খানকাতে পরিণত করা হয়নি, তাতে কোন প্রকার বাতিও জ্বালানো হয়নি। বর্তমানে কোন কোন এলাকাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কবরের উচুঁ ছবি পরিলক্ষিত হয়, যা দেখতে মাযারের মত তা মোটেই ঠিক নয়। এ ধরণের ছবি বানোয়াট। অতএব এ ধরণের জঘন্যতম অপরাধ থেকে আমাদেরকে ফিরে এসে সঠিক পথে চলা দরকার এবং আল্লাহর কাছে খালেছ ভাবে তাওবা করা দরকার। অন্যথায় পরকালে মুক্তির কোন উপায় নেই। আল্লাহ আমাদের মুক্তি দিন।
সূত্র : সালাফী বিডি