কুরবানির ফযিলত সংক্রান্ত প্রচলিত ১২টি জঈফ ও জাল হাদিস

নিঃসন্দেহে কুরআনের একাধিক আয়াত এবং বহু বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা সু প্রামাণিত যে, কুরবানি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন, মর্যাদাপূর্ণ আল্লাহর ইবাদত এবং তাঁর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম। এটি ইবরাহীম আলাইহি সালাম এর সুন্নত যা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে বাস্তবায়ন করেছেন, তাঁর উম্মতের জন্য শরিয়ত সম্মত করেছেন এবং যুগ-যুগান্তরে সাহাবি, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলিমগণ আমল করেছেন। আল হামদুলিল্লাহ।

তবে কুরবানির ফযিলতে বেশ কিছু হাদিস বক্তাদের মুখে শোনা যায় বা কুরবানি সংক্রান্ত বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। কিন্তু এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো একটি সহিহ নয়।

নিম্নে শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম এর লেখা ‘কুরবানির মাসায়েল’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে কুরবানির ফযিলত সংক্রান্ত প্রচলিত ১২টি জঈফ ও জাল হাদিস মুহাদ্দিসগণের পর্যালোচনা সহ তুলে ধরা হল:

হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন, “কুরবানি করার ফযিলতে অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেগুলোর একটিও বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত হয়নি বরং তার সবগুলোই জঈফ (দুর্বল) অথবা মউযূ (জাল)। (ফাতহুল বারী)

মালিকী মাজহাবের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুল আরবি রহ. বলেন,

ليس في فضل الأضحية حديث صحيح وقد روى الناس فيها عجائب لم تصح منها :إنها مطاياكم إلى الجنة – (عارضة الأحوذي شرح جامع الترمذي 6/288)

“কুরবানির ফযিলতে একটিও সহিহ হাদিস নেই। তবে মানুষ এ সম্পর্কে অনেক আজগুবি হাদিস বর্ণনা করেছে যা মোটেও সহিহ নয়। সে সব আজগুবি হাদিসের মধ্যে অন্যতম হল এই কথাটি:

((إنها مطاياكم إلى الجنة))

“উহা তোমাদের জান্নাতে যাওয়ার বাহন স্বরূপ।”(দ্র: তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থ আরেযাতুল আহওয়াযী ৬/২৮৮)

নিম্নে কুরবানির ফযিলত সংক্রান্ত হাদিসগুলো পর্যালোচনা সহ পরিবেশিত হল:

◈ ১ নং হাদিস:

عَنْ عَائِشَةَ ، أَنّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ : ” مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلًا ، أَحَبَّ إِلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ ، وَإِنَّهُ لَيَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقُرُونِهَا ، وَأَظْلَافِهَا ، وَأَشْعَارِهَا ، وَإِنَّ الدَّمَ لَيَقَعُ مِنَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا ”
(أخرجه ابن ماجة برقم 3126 والترمذي برقم 1493والحاكم 4/221-22 وانظر فقه الأضحية)

“আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, নবী বলেন, “কুরবানির দিনে কোন আদম সন্তান কুরবানির পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে মহান আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আমল করে না। সে কিয়ামত দিবসে উক্ত পশুর শিং, খুর, লোম প্রভৃতি নিয়ে উপস্থিত হবে এবং তার খুন জমিনে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নির্ধারিত মর্যাদার স্থানে পতিত হয়। অতএব, তোমরা প্রফুল্ল চিত্তে কুরবানি কর।” (ইবনে মাজাহ, হা/৩১২৬, তিরমিযী, হা/১৪৯৩, হাকেম৪ /২২১-২২২ দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ)

➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ, হাদিসটি র সনদে কয়েকটি দোষ আছে। যেমন:

● ১) উক্ত হাদিসের সনদে আব্দুল্লাহ বিন নাফে নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার স্মৃতি শক্তিতে দুর্বলতা ছিল।

● ২) হাদিসটি র সনদে আবুল মুসান্না নামক আরেকজন রাবী (বর্ণনা কারী) রয়েছে তার আসল নাম হল সুলাইমান বিন ইয়াজিদ। তিনি অত্যন্ত দুর্বল ও বাজে। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যা)

● ৩) উক্ত হাদিসের প্রায় অনুরূপ হাদিস ইমাম আব্দুর বাযযাক তার মুসান্নাফ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। (হা/৮১৬৭) উক্ত হাদিসটি র সনদেও আবু সাঈদ শামী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে তিনি একজন ‘পরিত্যক্ত’ রাবি। (দ্রঃ প্রাগুক্ত)

◈ ২ নং হাদিস:

عن زيد بن أرقم قال قال أصحاب رسول الله: يارسول الله ماهذه الأضاحي؟ قال: سنة أبيكم إبراهيم قالوا: فما لنا فيها؟ قال: بكل شعرة حسنة، قالوا: فالصوف يارسول الله؟! قال بكل شعرة من الصوف حسنة

“যায়েদ বিন আরকাম রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবিগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানির পশুগুলির তাৎপর্য কি? (কেন আমরা এগুলো জবেহ করে থাকি?) তিনি বললেন: “ইহা তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আঃ) এর সুন্নত।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, এতে আমাদের কী সওয়াব রয়েছে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “প্রত্যেকটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, পশমের মধ্যে যে ছোট ছোট লোম রয়েছে ওগুলোরও কি বিনিময় তাই? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “ছোট ছোট প্রতিটি লোমের বিনিময়ে একটি করে নেকী রয়েছে।” (ইবনে মাজাহ্, হা/৩১২৭, আহমদ (৪/৩৬৮), ইবনে হিব্বান ফিল মাজরুহীন (৩/৫৫))

➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ, এ হাদিসটি র সনদে আবু দাউদ আল আম্মী নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তার প্রকৃত নাম হল, নুফাই ইবনুল হারিস। সে মুহাদ্দিসগণের নিকট ‘পরিত্যক্ত’ রাবি। এতে আরও একজন রাবি রয়েছে তার নাম হল আয়েযুল্লাহ, সে ‘জঈফ’ রাবি।

◈ ৩ নং হাদিস:

عن أبي سعيد الخدري قال قال رسوالله صلى الله عليه وسلم لفاطمة عليها الصلاة والسلام!)) قومي إلى أضحيتك فاشهديها فإن لك بأول قطرة تقطر من دمها يغفر لك ماسلف من ذنوب، قالت: يارسول الله! هذا لنا أهل البيت خاصة أو لنا وللمسلمين عامة؟ قال: لنا وللمسلمين عامة (رواه الحاكم 4/222 والبزار مع كشف الأستار2/59)

আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ফাতেমা রা. কে বললেন, “(হে ফাতেমা!) তুমি তোমার কুরবানির পশুর নিকট (জবেহ কালীন) দাঁড়াও এবং উপস্থিত থাক। কারণ তার প্রথম ফোটা খুন (জমিনে) পড়ার সাথে সাথে তোমার অতীতের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হবে।”

ফাতেমা রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি আমরা আহলুল বায়েত তথা নবী পরিবারের জন্যই খাস নাকি তা আমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য?
তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “আমাদের জন্য এবং সাধারণভাবে সকল মুসলিমের জন্য প্রযোজ্য।” (হাকেম ৪/২২২, বাযযার মাআ কাশফিল আসতার-২/৫৯)

➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ,এর সনদে আব্দুল হামীদ নামে একজন রাবি রয়েছে যে জঈফ। আরেকটি কারণ হল, এর সনদে আতিয়া আল আওফী নামে আরেকজন রাবি রয়েছে সেও জঈফ এবং মুদাল্লিস। আবু হাতিম তার ইলাল (علل) গ্রন্থে (হা/৩৮) বলেন, “এটি একটি ‘মুনকার’ হাদিস।” (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ ১০)

◈ ৪ নং হাদিস:

عن علي رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لفاطمة: يا فاطمة فاشهدي أضحيتك أما إن لك بأول قطرة من دمها مغفرة لكل ذنب أما إنه يجاء بها يوم القيامة بلحومها ودمائها سبعين ضعفا حتى توضع في ميزانك

আলি রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন: “হে ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানির পশুর নিকট জবেহ করার সময় উপস্থিত থাকিও। জেনে রেখ, ঐ পশুর রক্তের প্রথম ফোটা (মাটিতে) পড়ার সাথে সাথে তোমার সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। জেনে রেখ! কিয়ামত দিবসে কুরবানির ঐ পশুগুলোকে রক্ত, মাংস সহ সত্তরগুণ বৃদ্ধি করে নিয়ে আসা হবে এবং তোমার দাঁড়িপাল্লায় তা রাখা হবে।” [বায়হাকী (৯/২৮৩) আবদুবনু হুমাইদ (৭/৮)]

➧ মন্তব্য:

● এ হাদিসের সনদে আমর বিন খালিদ ওয়াসেতী রয়েছে। তিনি একজন ‘পরিত্যক্ত’ রাবি।
● অনুরূপ এর সনদে আব্দুর রাযযাক যুহরী হতে ‘মুরসাল’ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ● এর সনদে আব্দুল্লাহ বিন মুহাররার নামক আরও একজন রাবী রয়েছে। তিনিও অত্যন্ত জঈফ।
● অনুরূপ হাদিস ইমরান বিন হুসাইন হতে বায়হাকী (৯/২৮৩), হাকিম (৪/২২২) এবং তাবারানী (১৮/২৩৯) প্রমুখগণ তাদের স্ব স্ব কিতাবে বর্ণনা করেছেন)। উক্ত হাদিসটি কে ইমাম তায়ালিসী (মুসনাদ তায়ালিসী (হা/২৫৩০) ও ইবনে আদী (৭/২৪৯২) বর্ণনা করেছেন। তবে তার সনদেও দুজন জঈফ রাবি রয়েছে তারা হলেন, নাযর বিন ইসমাইল এবং আবু হামযাহ শেমালী। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহ্)

◈ ৫ নং হাদিস:

عن على عن النبي صلى الله عليه وسلم : ))ياأيها الناس ضحوا واحتسبوا بدمائها وإن الدم وإن وقع في الأرض فإنه يقع في حرز الله عزو جل (رواه الطيالسي برقم 8315 ،والطبراني في الأوسط وفيه موسى بن زكريا وعمرو بن الحصين العقيلي وهما متروكان ، انظر: فقه الأضحية ومجمع الزوائد4/17)

আলি রা. হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, (তিনি বলেন) “হে মানব মণ্ডলী, তোমরা কুরবানি কর এবং তার খুনকে সওয়াব লাভের মাধ্যম মনে কর। নিশ্চয়ই কুরবানির পশুর খুন জমিনে পতিত হলে তা আল্লাহর হেফাজতে চলে যায়।” [আবু দাউদ তায়ালেসী, হা ৮৩১৫]

➧ মন্তব্য: হাদিসটি র সনদে মুসা বিন যাকারিযা এবং আমর ইবনুল হুসাইন রয়েছে। তারা উভয়ে ‘পরিত্যক্ত’ রাবি।

◈ ৬ নং হাদিস:

عن عبد الله ابن عباس رضى الله عنهما قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ماأنفقت الورق في شيئ أحب إلى الله من نحر ينحر يوم عيد (رواه الطبراني(১১/১৭) والدارقطني )৪/২৮২( والشجري في الأمالي )২/৭৯-৮০( وفي إسناده إبراهيم بن يزيد الخوزي وهو متروك ، انظر: فقه الأضحي)

“আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “চাঁদি (টাকা-পয়সা) যেসব ক্ষেত্রে খরচ করা হয় তার মধ্যে আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয় হল কুরবানি যা ঈদের দিনে যবেহ করা (তাবারানী ১১/১৭) দারাকুতনী ৪/২৮২ প্রভৃতি।

➧ মন্তব্য: উক্ত হাদিসটি জঈফ। কারণ হাদিসটি র সনদে ইবরাহীম বিন ইয়াজিদ আল খোযী নামক একজন পরিত্যক্ত রাবি রয়েছে।

◈ ৭ নং হাদিস:

عن الحسين بن علي قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((من ضحى طيبة بها نفسه محتسبا لأضحيته كانت له حجابا من النار ( رواه الطبراني ৩/ ৮৪، وفي إسناده : أبو داود النخعي (سليمان بن عمرو وهو كذاب

হুসাইন ইবনে আলী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরবানির পশুকে খুশী মনে ও নেকীর আশায় যবেহ করবে তার এই কুরবানির পশু জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্দা বা অন্তরায় হয়ে যাবে।”
মন্তব্য: এটি একটি মওযূ বা জাল হাদিস। এর সনদে আবু দাউদ নাখঈ (যার প্রকৃত নাম সুলাইমান বিন আমর) নামক একজন মহা মিথ্যুক রাবি রয়েছে।

◈ ৮ নং হাদিস:

عن عبدالله بن عباس قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: في يوم أضحى ماعمل ابن آدم في هذا اليوم أفضل من دم يهراق في سبيل الله إلا أن يكون رحما مقطوعة توصل
(رواه الطبراني11/32 وفي إسناده الحسن بن يحى الخشني وهو صدوق كثير الغلط وفيه ليث ابن أبي سليم وإسماعيل بن عياش وكلاهما ضعيف، انظر: فقه الأضحية

আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কুরবানির দিন বললেন, “কোন অদম সন্তান এই দিনে (কুরবানির) খুন প্রবাহিত করার চেয়ে অধিক সৎ আমল করে না। তবে ছিন্ন আত্মীয়তা সম্পর্ককে আবার অবিচ্ছিন্ন করার কথা ভিন্ন। (তাবারানী ১১/৩২)

➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ। কারণ,

● এর সনদে হাসান বিন ইয়াহয়া আল খোশানী নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছে। তিনি সত্যবাদী তবে প্রচুর ভুল করতেন।
● আরেকজন বর্ণনাকারী রয়েছে তার নাম লাইস বিন আবী সুলাইম তিনিও একজন জঈফ রাবি।
● এতে ইসমাইল বিন আয়্যাশ নামক অপর এক জন রাবী রয়েছে। তিনি যখন তিনি শাম বাসী ছাড়া অন্য এলাকার মুহাদ্দিস গনের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করবেন তখন তার হাদিস জঈফ বলে বিবেচিত হবে। আর এখানে তিনি শাম বাসী ছাড়া অন্যদের থেকে হাদিসটি বর্ণনা করায় তা জঈফের অন্তর্ভুক্ত।
● অনুরূপ হাদিস ইবনে আব্দুল বার তার ইস্তেযকার (৫/১৬৪) ও তামহীদ (২৩/১৯২) গ্রন্থে ইবনে আব্বাসের সূত্রে বর্ণনা করে সেটাকে ‘গারীব’ হাদিস বলে আখ্যায়িত করেছেন।
● এটির সনদে সাঈদ বিন যায়দ নামক জঈফ বারী রয়েছে। তিনি ইমাম মালিক (রহঃ) হতে মুনকার বা অগ্রহণযোগ্য অনেক কিছু বর্ণনা করতেন। (দ্রঃ ফিকহুল উযহিয়্যাহঃ ১১)

◈ ৯ নং হাদিস:

عن أبي هريرة عن النبي قال: استفرهوا ضحاياكم فإنها مطاياكم على الصراط – رواه الديلمي في مسند الفردوس 1/25( وهوحديث ضعيف جدا ، انظر : فقه الأضحية )

আবু হুরাইরা রা. নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “তোমরা তোমাদের কুরবানির পশুগুলো শক্তিশালী ও মোটা-তাজা দেখে নির্বাচন কর। কারণ এগুলো তোমাদের পুলসিরাতের উপর চড়ে যাওয়ার বাহন হবে।” (দাইলামী-মুসনাদুল ফিরদউস ১/৮৫)

➧ মন্তব্য: হাদিসটি অত্যন্ত জঈফ।
হাফেয ইবনে হাজার তালখীসুল হাবীর গ্রন্থে (৪/১৩৮) বলেন: “হাদিসটি মুসনাদুল ফিরদউস গ্রন্থের গ্রন্থকার ইবনুল মুবারক এর সূত্রে ইয়াহয়া বিন ওবায়দুল্লাহ্ বিন মাওহাব বর্ণনা করেছেন তার পিতা থেকে। তিনি আবু হুরায়রা হতে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেছেন…। তবে উক্ত সনদে বর্ণিত ইয়াহয়া অত্যন্ত জঈফ।
হাদিসটি ইমাম আলবানিও জঈফ বলেছেন। (দ্রঃ যঈফুল জামে হা/৯২৪)

◈ ১০ নং হাদিস:

عن عبد الله بن عمرو بن العاص أن النبي قال: أمرت بيوم الأضحى عيدا جعله الله لهذه الأمة – قال الرجل: أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثى أفأضحي بها؟ قال: لا، ولكن تأخذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فتلك تمام أضحيتك عندالله ( أخرجه أبو داود برقم 2788 وهو حديث ضعيف )
আমর ইবনুল ’আস হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আমি কুরবানির দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করার নির্দেশ প্রাপ্ত হয়েছি যা আল্লাহ এই উম্মতের জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন।
এক ব্যক্তি বলল: আপনার কি মত এ ব্যাপারে-আমি যদি একমাত্র দান কৃত দুধাল বকরি ছাড়া আর কিছু না পাই। তবে কি আমি ওটা জবাই (কুরবানি) করব?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “না (তা করবে না) বরং তুমি তোমার চুল, নখ, গোঁফ ও নাভির নিম্নদেশের লোম কাটবে। এটি আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণাঙ্গ কুরবানি বলে গণ্য হবে।”
➧ মন্তব্য: হাদিসটি জঈফ।
(আবু দাউদ, কুরবানির অধ্যায়, হা/২৭৮৮, নাসায়ী হাকেম (বৈরুত থেকে মুদ্রিত) ৪/২২৩ সনদ জঈফ। (দ্রঃ জঈফ আবু দাউদ হা/৫৯৫, জঈফ নাসায়ী হা/২৯৪। হাদিসটিকে ইমাম হাকেমও উক্ত জঈফ সনদে বর্ণনা করেছেন।)

◈ ১১ নং হাদিস:

عن عائشة رضى الله عنها أيها الناس ضحوا وطيبوا بها أنفسا فإني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: مامن عبد توجه بأضحيته ألى القبلة إلا كان دمها وقرنها وصوفها حسنات محضرات في ميزانه يوم القيامة، فإن الدم إن وقع في التراب فإنما يقع في حرز الله حتى يوفيه صاحبه يوم القيامة
(ذكره أبو عمر بن عبد البر في كتاب التمهيد، انظر: تفسير القرطبي )

আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে লোক সকল, আপনারা কুরবানি করুন এবং তা খুশী মনে করুন। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছি যে, “যদি কোন ব্যক্তি তার কুরবানির পশু সহ কিবলা মুখী হয় (এবং জবেহ করে) তাহলে তার রক্ত, শিং এবং লোম নেকিতে পরিণত করে কিয়ামত দিবসে তার দাঁড়িপাল্লায় উপস্থিত করা হবে। কুরবানির পশুর খুন যদিও তা মাটিতে পড়ে কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর হেফাজতে পড়ে। তিনিই এর প্রতিদান তাকে কিয়ামত দিবসে প্রদান করবেন।” (কিতাবুত তামহীদ এর বরাতে তাফসীরুল কুরতুবী)

➧ মন্তব্য: উক্ত হাদিসটির সনদও জঈফ।

◈ ১২ নং হাদিস:

عن ابن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: مامن نفقة بعد صلة الرحم أفضل عندالله من إهراق الدم
قال أبو عمر ابن عبد البر: وهو حديث غريب من حديث مالك، انظر: تفسير القرطبي

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টি ছাড়া এমন কোন খরচ নেই যা আল্লাহর নিকট কুরবানির পশুর খুন ঝরানোর চেয়ে উত্তম হতে পারে।” (তাফসীরুল কুরতুবী)।

➧ মন্তব্য: আবু ওমার ইবনে আব্দুল বার বলেন, “এ হাদিসটি ইমাম মালিকের সূত্রে বর্ণিত একটি ‘গারীব’ হাদিস” (দ্র: প্রাগুক্ত)।

কুরবানির ফযিলতে খাস কোন সহিহ বা হাসান হাদিস না থাকলেও নিম্ন বর্ণিত হাদিস দ্বারা পরোক্ষভাবে তার কিছু ফযিলত প্রমাণিত হয়। হাদিসটি হল:

عن ابن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ، [يَعْنِى أَيَّامَ الْعَشْرِ]. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ: وَلاَ الْجِهَادُ في سَبِيلِ اللَّهِ؟
قَالَ: وَلاَ الْجِهَادُ في سَبِيلِ اللَّهِ، إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيءٍ
(رواه البخاري )

ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুলাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের সৎ আমলের চেয়ে আল্লাহর কাছে অধিকতর প্রিয় কোন আমল নেই।
সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয়? রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “জিহাদও নয়। তবে ঔ ব্যক্তির কথা ভিন্ন যে নিজের জান ও মাল নিয়ে (জিহাদে) বেরিয়েছে এবং আর সে কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি (বুখারী)

যেহেতু কুরবানি করা ১০ যিলহাজ্জের অন্যতম একটি করণীয়। কাজেই সাধারণভাবে কুরবানিরও ফযিলত এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়। আল্লাহু আলাম।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: যঈফ বা দুর্বল হাদিস অনুযায়ী আমল করা যায় কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে দয়া করে এই পোস্টটি পড়ুন:

—————————
উৎস: ‘কুরবানির মাসায়েল’ শীর্ষক প্রবন্ধ (সামান্য পরিবর্তিত)
লেখক: শাইখ আখতারুল আমান বিন আব্দুস সালাম
সম্পাদক: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল