জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কায় এবং মান-ইজ্জত, সুনাম-সুখ্যাতি, পদমর্যাদা, পার্থিব স্বার্থ ইত্যাদি নষ্ট হওয়ার ভয়ে সত্য গোপন করা প্রসঙ্গে

জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কায় এবং মান-ইজ্জত, সুনাম-সুখ্যাতি, পদমর্যাদা, পার্থিব স্বার্থ ইত্যাদি নষ্ট হওয়ার ভয়ে সত্য গোপন করা প্রসঙ্গে:
অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সত্য বলা প্রত্যেক আল্লাহ ভীরু মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব এবং ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিবে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে জান-মালের ক্ষতির আশঙ্কায় ও দুনিয়াবী স্বার্থ নষ্ট হওয়ার ভয়ে সত্য বলা থেকে যেভাবে বিরত থাকা হচ্ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ইসলামী আকীদাহ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মুছে যেতে পারে আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে ইসলামী পরিচয়। তার স্থলে মুসলিম জাতির উপর চেপে বসতে পারে কুফরী, নাস্তিক্যবাদ, বিজাতীয় সংস্কৃতি, অশ্লীলতা, বেহায়াপনাসহ নানাবিধ কুসংস্কার।
আলেম, দাঈ ও সাধারণ মুসলিমগণ যেভাবে দিন দিন সত্য বলা থেকে পিছিয়ে আসছে, হিকমতের দোহাই দিয়ে যেভাবে মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে, তাতে ইসলাম ও মুসিলমদের সুবিধা হওয়ার বদলে অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই হেকমতের দোহাই দিয়ে সকল ক্ষেত্রেই হক বলা বর্জন করলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষের ভয়ে কিংবা পার্থিব স্বার্থ ছুটে যাওয়ার ভয়ে সত্য বলা পরিত্যাগ করার ভয়াবহ পরিণামের বিষয়টি কুরআনের অনেক আয়াত ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ “আহলে কিতাবদের সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের থেকে নিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, তোমরা কিতাবের শিক্ষা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে, তা গোপন করবেনা”। (সূরা আলইমরানঃ ১৮৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,
﴿لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ﴾
“নবী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের উপর দাউদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং পাপাচারে সীমালংঘন করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্ম ছিল বড়ই জঘণ্য”। (সূরা মায়িদাঃ ৭৯-৮০)
ইবনে মাজাহ শরীফে আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এই ভয়ের কথাই এসেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا يَحْقِرْ أَحَدُكُمْ نَفْسَهُ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ يَحْقِرُ أَحَدُنَا نَفْسَهُ؟ قَالَ: يَرَى أَمْرًا، لِلَّهِ عَلَيْهِ فِيهِ مَقَالٌ، ثُمَّ لَا يَقُولُ فِيهِ، فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: مَا مَنَعَكَ أَنْ تَقُولَ فِي كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ: خَشْيَةُ النَّاسِ، فَيَقُولُ: فَإِيَّايَ كُنْتَ أَحَقَّ أَنْ تَخْشَى
“তোমাদের কেউ যেন নিজেকে লাঞ্চিত না করে। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে আমাদের কেউ নিজেকে লাঞ্চিত করতে পারে? তিনি বললেন, বান্দা কখনো এমন অন্যায় কাজ দেখে, যার প্রতিবাদ করা কেবল আল্লাহ তাআলার জন্যই তার উপর আবশ্যক হয়। অথচ সে তার প্রতিবাদ করেনা। আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকে জিজ্ঞাসা করবেন, অমুক অমুক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কিসে তোমাকে বারণ করেছিলো? বান্দা বলবে, মানুষের ভয়। আল্লাহ তাআলা বলবেন, কেবল আমাকে ভয় করাই তোমার উপর আবশ্যক ছিল”। ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহ ضعيف الجامع গ্রন্থে হাদীছটিকে যঈফ বললেও এর সমর্থনে আরো অনেক সহীহ হাদীছ রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَا يَمْنَعَنَّ رَجُلًا هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ “কেউ যখন সত্য জানতে পারবে তখন মানুষের ভয় যেন তাকে সত্য বলা থেকে বারণ না করে”। তিরিমযী, ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রাহিমাহুল্লাহ আরো বাড়িয়ে বলেন যে, فإنه لا يُقرِّب من أَجَلٍ ولا يُبَاعد من رِزْقٍ “কেননা সত্য বলা মানুষকে মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দেয়না এবং রিযিক থেকেও দূরে সরিয়ে দেয়না”।
প্রথমোক্ত হাদীছের উপর আলোকপাত করতে গিয়ে ইমাম আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এই হাদীছে মানুষের ভয়ে অথবা পার্থিব স্বার্থ হাসিল করার জন্য সত্য গোপন করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি মানুষের কষ্ট যেমন মারপিট, গালমন্দ ইত্যাদির ভয়ে কিংবা রিযিক চলে যাওয়ার আশঙ্কায় অথবা মানুষের নিকট তার মান-ইজ্জত ও সুনাম-সুখ্যাতি নষ্ট হয়ার আশঙ্কায় সত্য গোপন করবে, সে হাদীছে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধীতাকারী বলে গণ্য হবে। জেনে-বুঝে সত্য গোপনকারীর অবস্থা যদি এ রকম হয়, তাহলে যারা সত্য গোপন করেই ক্ষ্যান্ত হয়না; বরং নিরপরাধ মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং বাতিলের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়, হকপন্থীর দ্বীন ও আকীদাহয় মিথ্যা অপবাদ দেয় অথবা তাদের বাতিলের সমর্থন না করলে তারা হকপন্থীকেই বাতিল আকীদাহ পোষণকারী হিসাবে অপবাদ দেয়, তাদের পরিণাম কী হতে পারে? (ঈষৎ পরিবর্তনের সাথে ইমাম আলবানীর কথা এখানেই শেষ)
সুতরাং আমরা সুস্পষ্ট করে সত্য বলতে চাই। সাধ্যানুসারে ইসলামের পক্ষে কথা বলতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করিনা। আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য যা নাযিল করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য যে সুন্নাত রেখে গেছেন, আমরা মানুষের কাছে তা নির্ভয়ে বর্ণনা করতে চাই।
একই সময়ে আমরা ঐসব নব্য মূর্তিপূজা, নতুন নতুন শির্ক ও সকল প্রকা অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ বিধ্বংসী বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চাই, যা নাস্তিক ও মুশরিকদের অন্ধ অনুসরণ করে আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা কুরআনের পক্ষে কথা বলতে চাই। মুসলিমদের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাই।
এ মূহুর্তে প্রত্যেক মুমিন নরনারী, আলেম ও দাঈদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত। আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবোনা। সত্য বললেই জান মালের ক্ষতি হবে এবং পার্থিব স্বার্থ নষ্ট হবে, -এই ভয়ে আমরা সত্য বলা হতে মোটেই পিছপা হতে পারিনা। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর হাতে।
আলেমগণ বলেছেন, শারীরিক ও মানসিক সামান্য কষ্ট এবং পার্থিব ভোগবিলাস ও স্বার্থ ছুটে যাওয়ার সন্দেহ হলেই সত্য বলা পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ। হত্যার আশঙ্কার বিষয়টি ভিন্ন। তাও আবার সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেত্রে। তবে যারা জাতীয় পর্যায়ের আলেম ও দাঈ তাদের জন্য কোনো অবস্থাতেই সত্য গোপন করা জায়েয নেই। আল্লাহর জন্য তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করবেন। আমাদের সামনে চারমাজহাবের চারজন বিজ্ঞ ইমাম, ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবসহ আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তারা সত্য বলার ক্ষেত্রে জান-মালসহ কোনো কিছুরই ক্ষতির ভয় করেন নি। তাদের ত্যাগের কারণেই ইসলাম আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে। আশা করি আমাদের আলেমগণ সালাফে সালেহীনদের পর্থেই চলবেন।
সুতরাং মুসলিম যুবক-যুবতীদের বিবেক-বুদ্ধি ও অন্তরকে শির্ক, কুফরী এবং ইউরোপ-আমেরিকা ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অপসংস্কৃতি, নোংরামি ও কুসংস্কার থেকে পবিত্র রেখে তাতে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আলেমদের অবহেলা, জান-মাল ও ইজ্জতের ভয় মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আহমাদ বিন হান্বালকে হত্যা করার জন্য যখন তারতুসে অবস্থানরত খলীফা মামুনের দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখণ ইমাম আহমাদের অন্যতম সাথী আবু জা’ফর আলআন্বারী ফুরাত নদী পার হয়ে ইমামের সাথে সাক্ষাত করতে আসলেন। ইমাম তাকে দেখে বললেনঃ হে আবু জা’ফর! এত কষ্ট করে আমার সাথে দেখা করতে আসার কী প্রয়োজন ছিল? জবাবে আবু জা’ফর বললেনঃ ওহে আহমাদ! শুন! তুমি আজ মানুষের নয়ন মনি, তুমি সকলের মাথা! মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা তোমার অনুসরণ করবে। আল্লাহর কসম! তুমি যদি কুরআকে মাখলুক বলো, তাহলে আল্লাহর বান্দারা তাই বলবে। আর তুমি যদি তা বলতে অস্বীকার করো, তাহলে অগণিত মানুষ কুরআনকে মাখলুক বলা হতে বিরত থাকবে। হে বন্ধু! ভাল করে শুন। খলীফা যদি তোমাকে এবার হত্যা নাও করে, তাহলে তুমি একদিন মৃত্যু বরণ করবেই। মরণ একদিন আসবেই। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করো। খলীফার কথায় তুমি কুরআনকে সৃষ্টি বলতে যেয়োনা।
কথাগুলো শুনে ইমাম আহমাদ কাঁদতে লাগলেন এবং বললেনঃ ما شاء الله “আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তাই হবে”। অতঃপর তিনি বললেনঃ হে আবু জা’ফর! কথাগুলো তুমি আরেকবার বলো। আবু জা’ফর কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারও ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন, মাশা-আল্লাহ।
আমরা আশা করি বিলম্বে হলেও সত্যের এই দুর্বল আওয়াজ প্রতিটি মুসলিমের কানে পৌছবে এবং তাদেরকে জাগ্রত করবে। কথাগুলো যেন আল্লাহ তাআলা তাঁর সন্তুষ্টির জন্য কবুল করেন। আমীন।

সংগ্রহঃ_____________শায়েখ Abdullah Shahed Al-Madani