আমি এই নিবন্ধটি শুরু করছি একটি প্রশ্ন দ্বারা,
আমরা কি ইসলামের স্বার্থে কখনো ত্যাগ স্বীকার করেছি?
আমাদের পছন্দনীয় কোন কিছু বিসর্জন দিয়েছি?
আমাদের ভালোবাসার কোন কিছু ছেড়ে দিয়েছি?
ইসলামের জন্য এমন কোন কিছু ত্যাগ করেছি যা আমরা সঞ্চিত করে রেখেছিলাম?
- এমন অনেক জিনিসই আমাদের জীবনে রয়েছে যা আমরা মিস করেছি। আমাদের জীবন যা এখনো অনেক তরুণ, আমরা মনে করি যে আমাদের দ্বীনের জন্য ত্যাগ করার প্রয়োজন নেই।বরঞ্চ, আমরা এই দ্বীনের বাইরের জিনিসের ব্যাপারে ত্যাগ করার দিকে আগ্রহী। যেমনঃ বন্ধুত্বের জন্য ত্যাগ স্বীকার, দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার, বন্ধুদের জন্য ত্যাগ স্বীকার, ভালোবাসার মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার এমনকি এমন কোন কিছুর জন্য ত্যাগ স্বীকার যেটা কিনা নিতান্তই কৌতুকপূর্ণ। এইগুলোর জন্য ত্যাগ স্বীকার অনেক সহজ মনে হয়। কিন্তু ইসলামের স্বার্থে ত্যাগ স্বীকার করাটাকে অনেক ভারী মনে হয়।
আমাদের এখনো মনে আছে যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) কত উদার ব্যক্তি ছিলেন, তিনি আল্লাহর জন্য নিজের বৎসকেও জবেহ্ করার ইচ্ছা করেছিলেন। একটি সন্তানের জন্য আকুল এক পিতা, যিনি কিনা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেই পুত্রকে উৎসর্গ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, এটাই হল সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার।
“নিশ্চয়ই ইব্রাহীম ছিলেন এক সম্প্রদায়ের প্রতীক, সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহরই অনুগত এবং তিনি শেরককারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।”(সূরা নাহলঃ১২)
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা কর, তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। আর যে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জানা উচিত যে, আল্লাহ বেপরওয়া, প্রশংসার মালিক।”(সূরা মুমতাহিনাঃ৬)
হযরত ইবরাহীম (আঃ) আমাদের সামনে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর ত্যাগ স্বীকারের স্পৃহা তেমনই মহান ছিল যেমনটি ছিল ইসলামের প্রতি তাঁর ভালোবাসার স্পৃহা। সেই স্পৃহাটাই আজ আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত।
আমাদের ভালোবাসা এবং ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা এখনো অনেক ক্ষুদ্র।
অবশ্যই এই ধরনের ত্যাগ স্বীকার কোন প্রকার অনুশীলন ব্যতীত সম্ভব ছিল না। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত তাকওয়ার বিভিন্ন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন। আর তিনি সেগুলোর প্রত্যেকটিতে শতভাগ সফলতার সাথে পাস করেছিলেন। মনে করে দেখুন, কিভাবে ইবরাহীম (আঃ) মরুভূমির নির্জন প্রান্তরে তাঁর পত্নীকে নির্বাসিত করেছিলেন। এগুলোর সবই হল পরীক্ষা যেগুলোর মাধ্যমে ইসলামের স্বার্থে আমাদের ত্যাগ স্বীকারের মানসিকতা নিরূপিত হয়।
❒ সময় এসেছে ত্যাগ স্বীকারের প্রশিক্ষণ লাভ করার,
আসুন জেনে নিই একজন সাহাবীর ঘটনা এবং তিনি ইসলামের জন্যে কি ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন সেই ঘটনা।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট একজন অতি সাধারণ সাদামাটা একজন লোক কিছু প্রশ্ন নিয়ে উপস্থিত হলেন, তিনি সা’দ আল আসওয়াদ আল সুলুমি নামে পরিচিত, তিনি জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমিও কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারব?” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর করলেন, “অবশ্যই! অবশ্যই তুমিও জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে যদি তুমি একজন বিশ্বাসী হয়ে থাক”। সা’দ অবাক হয়ে বললেন,“কিন্তু আমি! আমি তো বিশ্বাসীদের মাঝেও অতি সাধারণ নগণ্য একজন মানুষ !” নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “হে সা’দ অন্যান্য বিশ্বাসীদের জন্যে যা পুরষ্কার রয়েছে তোমার জন্যেও অনুরুপ রয়েছে,”
“তাহলে কেন কেউই তার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়না?”, সা’দ জানতে চাইলেন। উল্লেখ্য, তিনি এতই সাধারণ একজন লোক ছিলেন যে, সামাজিক তথাকথিত মান মর্যাদাহীনতার কথা তুলে কেউই তাদের মেয়েকে তাঁর সাথে বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছিলেন না।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ইবন আল-ওয়াহাব এর নিকট যাওয়ার উপদেশ দিলেন, তিনি ছিলেন মদীনার সম্ভ্রান্ত নেতাদের একজন যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, এবং তাঁর কন্যা সৌন্দর্যের কারণে অন্যান্য নারীদের চেয়ে বিশিষ্ট ও সুপরিচিত ছিলেন।
নবীজী সা’দ কে এই উপদেশ দিলেন যে তিনি যেন ইবন আল-ওয়াহাব এর নিকট গিয়ে বলেন যে, আল্লাহর রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব এসেছে যে, ইবন আল-ওয়াহাব যেন সা’দ এর সাথে তাঁর কন্যার বিয়ে দেন।
সা’দ তাঁর নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ইবন আল ওয়াহাব এর বাড়িতে হাজির হলেন, তিনি খুশি এবং উত্তেজনায় যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিলেন। যিনি কিনা মদীনার অতি সাধারণ একজন নগণ্য মানুষ তিনি বিয়ে করবেন একজন সম্ভ্রান্ত নেতার সুন্দরী কন্যাকে! তিনি দরজার কড়া নেড়ে ইবন আল ওয়াহাবকে বললেন, আল্লাহর রাসূল আপনার নিকট আমাকে প্রেরণ করেছেন, আর তিনি অনুরোধ করেছেন আপনি যেন আমার সাথে আপনার কন্যার বিয়ে দেন।
ইবন আল ওয়াহাব সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, “তুমি ! তোমার কাছে আমার মেয়ে ! তুমি কি আমার মেয়ের সম্পর্কে কিছুই জাননা ! সে তার সৌন্দর্যের জন্যে বিখ্যাত” এবং তিনি উপদেশ দিলেন সা’দ যেন বাড়ি চলে যায়।
যখন সা’দ ভগ্ন মনে হাঁটতে শুরু করলেন, তারপূর্বে ইবন আল ওয়াহাব এর কন্যা তাদের এই কথোপকথন শুনে ফেলেন, তিনি বলেন, “ও আব্বা, থামুন, থামুন ! এটা আল্লাহর রাসূলের পক্ষ থেকে অনুরোধ। আমরা যদি আল্লাহর রাসূল এর অনুরোধ প্রত্যাখান করি তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায় হবে? আমাদের অবস্থান কোথায় হবে যদি আমরা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সচেতনতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই? আমি বলছি আমরা কোথায় থাকব, আমরা এখানেই থাকব আজ আমরা যেখানে আছি !” এবং তিনি সা’দ কে বললেন, “আল্লাহর রাসূলের নিকট যান, তাঁকে বলুন আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি আছি”।
সা’দ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে গেলেন এবং তিনি ছিলেন আনন্দে বিভোর ! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিয়ের মোহরানা ঠিক করলেন ৪০০ দিরহাম। একথা শুনে সা’দ অবাক হয়ে বলেন, “৪০০ দিরহাম ! হে আল্লাহর রাসূল, আমি নিজের চোখে কখনও ৪০০ দিরহাম দেখিনি !” রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নির্দেশ দিলেন তিনি যেন আলী, আব্দুর রহমান ইবন আউফ এবং উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম এর নিকট যান এবং প্রত্যেককে ২০০ দিরহাম করে দিতে বলেন। তাঁরা প্রত্যেকে ২০০ দিরহামের আরও বেশি করে দিলেন।
নিজের স্ত্রীর নিকট যাওয়ার পূর্বে তিনি একটি বাজারের নিকট থামলেন, তিনি ভাবলেন তাঁর স্ত্রীর জন্যে কিছু উপহার কিনে নিয়ে যাবেন। বাজারে অবস্থান কালেই তিনি শুনলেন, জিহাদের জন্যে আহবান করা হচ্ছে এবং অস্ত্রসহ তৈরি হবার জন্য আহবান করা হচ্ছে। সা’দ যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আকাশের দিকে মাথা ঊঁচু করে বললেন, “হে আল্লাহ ! আমি এই দিরহামগুলোর বিনিময়ে এমন কিছু কিনব যা আপনাকে সন্তুষ্ট করবে”। তিনি একটি তরবারী কিনলেন, একটি ঘোড়া কিনলেন এবং আল্লাহর রাসূলের চোখ এড়ানোর জন্যে নিজের মুখমণ্ডল একটি কাপড়ে ঢেকে নিলেন। কারণ তিনি জানতেন, যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দেখে ফেলেন তাহলে তিনি তাঁকে বাড়ি ফেরত পাঠাবেন কারণ তিনি মাত্রই বিয়ে করেছেন , তিনি সদ্য বিবাহিত।
সাহাবীরা বলাবলি শুরু করলেন, “কে এই লোক, মুখ ঢেকে ঘোড়া ছুটিয়ে জিহাদের জন্য আসছে”? আলি রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব করলেন, “ ছাড় তাকে, সে জিহাদের জন্যে আসছে”। সা’দ সাহসিকতার সাথে বীরদর্পে ঘোড়া ছুটিয়ে ময়দানে মিশে গেলেন, এবং এক পর্যায়ে তাঁর ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গেল, তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, এবারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গাঢ় চামড়ার রং দেখে তাঁকে চিনে ফেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্ন করলেন, “হে সা’দ, এটা কি তুমি?” সাদ বলেন, “হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতা মাতার জান আপনার জন্য কুরবান হোক, এটা সাদ”।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “হে সাদ, তোমার জন্যে জান্নাত ছাড়া আর কোন পুরষ্কার নেই” একথা শুনে সাদ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং দৌড়ে যুদ্ধের ময়দানে হারিয়ে গেলেন। একটু পর শোনা গেল, লোকেরা বলছে সাদ আহত হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দৌড়ে গেলেন সাদকে দেখার জন্যে। তিনি খুঁজতে লাগলেন, তিনি যুদ্ধাহত সাদের মাথা নিজের কোলে রাখলেন, প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চোখের অশ্রু সাদের মুখমণ্ডলে পড়তে লাগল, নবীজী কাঁদতে শুরু করলেন। একটু পর তিনি হাসতে শুরু করলেন, এরপর তিনি তাকালেন।
❒ এ অবাক করা ঘটনার সময়ে সেখানে একজন সাহাবা ছিলেন, যার নাম ছিল আবু লুবাবা, তিনি বলেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আজ আপনাকে এমন এক অবস্থায় দেখলাম যা আমি আগে কখনো দেখিনি, প্রথমে আপনি কাঁদলেন, এরপর হাসলেন এরপর আপনি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন”। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,“আমি কাঁদলাম কারণ আমার প্রিয় একজন সাহাবী মৃত্যু বরণ করল, আমি দেখলাম সে আমার জন্যে কতটুকু ভালোবাসা সঞ্চিত করে রেখেছিল, আমি দেখলাম তাঁর ত্যাগ। কিন্তু যখন আমি দেখলাম আল্লাহর নিকট হতে তাঁর জন্যে কি অপেক্ষা করছে, সে হ’দ এ পৌঁছে গেছে”। আবু লুবাবা বলেন, “হ’দ কি?” । “এটা জান্নাতের এমন একটি ঝর্ণা যেখান থেকে কেউ পান করলে আর কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না”, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর করলেন, “এটা মধুর চেয়েও মিষ্টি আর দুধের চেয়েও সাদা, আর আমি যখন দেখলাম আল্লাহর নিকট তাঁর মর্যাদা কিরূপ, আমি হাসতে শুরু করলাম। এরপর আমি আরও দেখলাম জান্নাতে তাঁর জন্যে অপেক্ষমাণ স্ত্রীগণ সাগ্রহে দৌড়ে ছুটে আসছে, যখন তাঁদের পায়ের গোঁড়ালি আমার নজরে আসল, তখন আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম”।
এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের নিকট আসলেন এবং সাদের তরবারী এবং ঘোড়া নিয়ে আসতে আদেশ করলেন। তিনি এগুলো সাদের স্ত্রীকে উপহার দিলেন এবং জানিয়ে দিলেন এগুলো তোমার উত্তরাধিকার। এবং আরও জানালেন, আল্লাহ জান্নাতে সাদকে যে স্ত্রীদের সাহচর্য দান করেছেন তাঁরা আরও অনেক বেশি সুন্দরী।
❒ এতক্ষণ আমরা জানলাম এমন একজন অতি সাধারণ মদীনাবাসীর কথা, যে জানতো না কিভাবে তাঁর মতন অতি সাধারণ একজন মানুষ জান্নাত লাভ করতে পারে, যার কাছে কিনা মেয়ে বিয়ে দিতেও কেউ রাজি হতো না। সমাজে তাঁর ছিলনা কোন মান মর্যাদা, কিন্তু মর্যাদাশীল ছিলেন তিনি মহান আল্লাহর নিকট ! কারণ তিনি জীবন এবং মরণ , জান এবং মাল ব্যয় করেছেন শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যে।
❒ কত মহান ছিল এই আত্মত্যাগ, তিনি শুধু নিজের জান আর মালকেই কুরবানি করে ক্ষান্ত হননি, কুরবানি করেছেন এমন একটি সময়ে যখন তিনি একজন সদ্য বিবাহিত যুবক, যিনি জিহাদে অংশগ্রহণ না করলেও পারতেন, এমনকি তিনি আশংকা করছিলেন আল্লাহর রাসূল তাঁকে চিনে ফেললে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারেন, যেখানে আমরা কোন সামান্য অজুহাতে কষ্ট স্বীকার না করার পথ বেছে নেই, সেখানে তিনি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন আত্মত্যাগের পথ !
❒ যেখানে তিনি নিরাপদে, আনন্দে বিভোর থাকতে পারতেন মদীনার অন্যতম সেরা সুন্দরী নারীর সদ্য বিবাহিত স্বামী হিসেবে সেখানে তিনি জিহাদের ঘোষণা শোনামাত্রই ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত হয়ে গেলেন ! যেখানে তিনি গিয়েছিলেন নিজের স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার উপহার ক্রয় করতে সেখান থেকে ফেরত আসলেন একটি যুদ্ধের ঘোড়া ও তরবারী কিনে! সুবহানাল্লাহ !
“হে আল্লাহ! সমস্ত প্রশংসা তোমার জন্য। তুমি আকাশমণ্ডলী–পৃথিবী ও এর মধ্যকার সকল কিছুর নূর। সমস্ত প্রশংসা তোমার জন্যই। তুমি আকাশমণ্ডলী–পৃথিবী ও এর মধ্যকার সকল কিছুর রক্ষক। সকল প্রশংসা তোমার, তুমি আকাশমণ্ডলী–পৃথিবী ও এর মধ্যকার সকল কিছুর প্রতিপালক। তুমি সত্য, তোমার প্রতিশ্রুতি সত্য। তোমার বাণী সত্য। তোমার দর্শন লাভ সত্য। জান্নাত সত্য। জাহান্নাম সত্য। নবিগণ সত্য। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য। কেয়ামত সত্য”। [বোখারি : ৫৮৪২]
তিনি আল্লাহকে ভালোবেসেছিলেন সবার থেকে বেশি এবং নিজের কাজের মাধ্যমে তা প্রমাণ করলেন ।
❒ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এই মহান আত্মত্যাগের ঘটনা থেকে আমাদের অনুপ্রাণিত করুন, ইসলামের স্বার্থে আত্মত্যাগ করার জন্যে আমাদের অন্তরকে উন্মুক্ত করে দিন। আমাদেরকে দান করুন জান্নাতুল ফিরদাউস, আমিন!
আব্দুল্লাহ ইবনে ’উমার নামে একজন সাহাবী ছিলেন। তিনি যখন তেরো বছর বয়সে পদার্পণ করেছিলেন, তখনই রাসূলুল্লাহর সাথে জিহাদে যোগদান করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আল-বাররা বদরেরে যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহর ফৌজের পাশাপাশি যুদ্ধ করার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ্ এটার অনুমোদন করেন নি, কেননা তাঁরা তখনো কিশোর ছিলেন। পরের বছর উহুদের যুদ্ধেও তিনি অংশ নিতে পারেন নি রাসূলুল্লাহর অমতের কারণে, কেবলমাত্র আল-বাররা অংশ নিতে পেরেছিলেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের তাঁর এই অদম্য আকাঙ্খা বাস্তবে পরিণত হয়েছিল আহযাবের যুদ্ধের সময়। রাসূল (সাঃ) তাঁকে মুসলিম সৈন্যেদলে নিয়োগদান করেছিলেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য, সুবহানাল্লাহ।
❒ আব্দুল্লাহ্ ইবনে ’উমারের মত হওয়ার জন্য আমাদের নিজেদের প্রশিক্ষণ দেয়া উচিত।
প্রথমেই আমাদের যেটা করতে হবে সেটা হল নিজেদের নফসকে (প্রবৃত্তি) নিয়ন্ত্রণের চর্চা করা। এই নফসই আমাদেরকে আত্মশ্লাঘাপূর্ণ হতে মদদ দেয়। নিজেদের অস্তিত্বের তাৎপর্য, স্বার্থপর মানসিকতা ত্যাগ না করা পর্যন্ত আত্মত্যাগ স্বীকার আমাদের জন্য দুরূহ হবে।
- যাদের ঈমান দুর্বল,শারীরিক বাসনা অনেক সময় তাদেরকে প্রলোভিত করতে সফল হয়। বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কাজের প্রকোষ্ঠে নিয়ে যায় কারণ তারা আল্লাহর প্রেরিত নির্দেশনা অনুসরণ করে না। আল্লাহ্ বলেন, “অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জানবেন, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে? নিশ্চয় আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না।”(সূরা ক্বাছাছঃ৫০)
অন্য আরেকটি আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “আপনি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছেন, যে তার খেয়াল–খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মহর এঁটে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব, আল্লাহর পর কে তাকে পথ প্রদর্শন করবে?তোমরা কি চিন্তাভাবনা কর না?”(সূরা জাছিয়াহ্ঃ২৩)
❒ ঐন্দ্রিয়ীক বাসনা হল এমন একটা জিনিস যেটাকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তবে আমাদেরকে এও মনে রাখতে হবে যে এটা সম্পূর্ণরূপে নিবারিত করা যাবে না। দৈহিক বাসনাকে কেবলমাত্র প্রশমিত কিংবা নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব। অবশ্যই সেটা করতে হবে ইসলামিক বিধিমালা অনুযায়ী, অন্য কোন কিছু দ্বারা নয়। কারণ, একমাত্র আল্লাহ্ সুবহানাওয়াতা’আলাই মানবজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যাবলী সম্বন্ধে সম্যক অবহিত। আর এই কারণেই আল্লাহর পক্ষ হতে মানবজাতির জন্য নির্দেশাবলী প্রেরিত হয়েছে, আর তা হল মানুষ আল্লাহর প্রতি অনুগত থাকবে, মানুষ তার স্বীয় সত্তার মাগফেরাতের জন্যই সেটা করবে। শারিরীক প্রবৃত্তি দমন করার জন্য সেই সমস্ত কার্যাবলী পরিহার করা আবশ্যক যেগুলোর মাধ্যমে প্রবৃত্তি সন্তুষ্ট ও আনন্দিত হয়।
❒ দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র বিষয়াবলী ত্যাগ করতে সচেষ্ট হতে হবে। প্রতিটি বৃহৎ জিনিসই শুরু হয় ক্ষুদ্র হতে। চেষ্টা করুন অল্প অল্প করে ত্যাগ স্বীকার করার। ইসলামের জন্য শক্তি, সময় ও সুযোগ ত্যাগ করার চেষ্টা করুন। তারপর ধীরে ধীরে সম্পদ ত্যাগ করার মাধ্যমে। কারণ, আমাদের আত্মিক উন্নতি লাভ করা প্রয়োজন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের আত্মা সবসময়ই নফসের প্রতি দুর্বল থাকে। তাই, একে সর্বদাই কল্যাণের দিকে পরিচালিত করতে হবে এবং রক্ষা করতে হবে।
মুসলিমদের ব্যাপারে নিজেদের জড়ানোর চেষ্টা করুন। চেষ্টা করুন তাদের বোঝা লাঘব করার। ঐ ক্ষেত্রে এমন কোন কিছু করার চেষ্টা করুন যেগুলো আমাদের জন্য সুবিধাজনক ও আমাদের পারদর্শীতা রয়েছে। ইতস্তত করবেন না, সন্দেহবাতিক হবেন না কিংবা লজ্জা পাবেন না। এটাই হল সময়, ইসলাম আমাদের কাছ থেকে বড় কিছু পাবার অপেক্ষায় আছে।
“হে আল্লাহ ! তুমি ঈমানকে আমাদের নিকট সুপ্রিয় করে দাও, এবং তা আমাদের অন্তরে সুশোভিত করে দাও। কুফর, অবাধ্যতা ও পাপাচারকে আমাদের অন্তরে ঘৃণিত করে দাও, আর আমাদেরকে হেদায়েত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে মুসলমান হিসেবে মৃত্যু দাও। আমাদের মুসলমান হিসেবে বাঁচিয়ে রাখ। লাঞ্ছিত ও বিপর্যস্ত না করে আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের সাথে সম্পৃক্ত কর”। [আহমদ : ১৪৯৪৫]
- মূলঃ বুরহান সদিক কর্তৃক ইন্দোনেশীয় ভাষায় প্রকাশিত
- সম্পাদনা ও ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদঃ সরল পথ