মে মাসে সুরাইয়া তারকাপুঞ্জের উদয়ের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের বিদায়: বিভ্রান্তির জবাব এবং কঠিন সতর্কবার্তা

মে মাসে সুরাইয়া তারকাপুঞ্জের উদয়ের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের বিদায়:
বিভ্রান্তির জবাব এবং কঠিন সতর্কবার্তা
▬▬▬▬◒◒◒▬▬▬▬
“১২ মে ২০২০ রমাযানে সুরাইয়া তারকাপুঞ্জ (কৃত্তিকা/Pleiades) এর উদয় হলে করোনা ভাইরাসের পরিসমাপ্তি হবে।” এ প্রসঙ্গে সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ড. শাইখ সালেহ আস সুহাইমী (হাফিযাহুল্লাহ) বিশ্ববাসীর কাছে এক কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছেন। নিম্নে তার হুবহু অনুবাদ পেশ করা হল:

শাইখ সুহাইমী (হাফিযাহুল্লাহ) বলেন:

“আমি একটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাই। তা হল, বর্তমানে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একটি হাদিস সম্পর্কে আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। হাদিসটিকে কোন কোন আলেম সহিহ বলেছেন। তা হল: “যদি কোন রোগ-বালায়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে তাহলে সুরাইয়া তারকার আবির্ভাবের মাধ্যমে তা শেষ হয়ে যায়।” অর্থাৎ কদিন পরে ভোর রাতে সুরাইয়া তারকা উদিত হলেই বিপদাপদ (করোনা-মহামারী) শেষ হয়ে যাবে!
এমন দুর্যোগকালীন সময়ে এ সব কথাবার্তা প্রচার করা জায়েজ নেই। এর কারণ চারটি। যথা:

◉ প্রথম কারণ:

এ হাদিসটি যদি সহিহ হয়ে থাকে তাহলে তা দ্বারা ফসলের রোগ-বালাই উদ্দেশ্য। মানুষ যে সকল রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় সেগুলো উদ্দেশ্য নয়।
আর এটিই সঠিক কথা যে, এটি চাষাবাদ ও ফসলাদির সাথে সম্পৃক্ত। আলেমগণও এ ব্যাপারে একমত হয় নি যে, মানুষ যে সকল রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় সেগুলোও এর অন্তর্ভূক্ত।

◉ দ্বিতীয় কারণ:

এ হাদিসের প্রচারণাকে কেন্দ্র করে যে সকল মানুষ ইতোমধ্যে আল্লাহর দিকে ফিরে এসেছিল এবং যাদের ঈমান মজবুত হয়েছিল এখন তারকার উপর ভিত্তি করে তাদের ঈমান আবার দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

◉ তৃতীয় কারণ:

এই বিষয়টি হয়তো নক্ষত্রের সাথে সম্পৃক্ততা বা জ্যোতিষ শাস্ত্রের দিকে ঠেলে দিবে অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে কুদসিতে বলেন, আল্লাহ বলেছেন:
أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنٌ بِي، وَكَافِرٌ، فَأَمَّا مَنْ قَالَ: مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ، فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِي كَافِرٌ بِالكَوْكَبِ، وَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِنَوءِ كَذَا وَكَذَا، فَذَلِكَ كَافِرٌ بِي مُؤْمِنٌ بِالكَوْكَبِ»
“আমার বান্দাদের মধ্যে কিছু বান্দা মুমিন হয়ে ও কিছু কাফের হয়ে প্রভাত করেছে। যে ব্যক্তি বলেছে যে, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও তাঁর দয়ায় আমাদের উপর বৃষ্টি হল’, সে তো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী [মুমিন]ও নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী [কাফের]। আর যে ব্যক্তি বলেছে যে, ‘অমুক অমুক নক্ষত্রের ফলে আমাদের উপর বৃষ্টি হল’, সে তো আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী [কাফের] এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী [মুমিন]।’’ (বুখারী ও মুসলিম)

আর ভূ-পৃষ্ঠের কোন ঘটনা বা দুর্ঘটনার উপর আকাশের নক্ষত্রের কোন প্রভাব আছে এমন বিশ্বাস পোষণা করা হল ভ্রান্ত বিশ্বাস বরং তা আল্লাহর সাথে শিরক। যেমন কিছু মানুষ বিশ্বাস করে যে, অমুক তারকা উদিত হয়েছে সুতরাং এটা ঘটবে…ওটা ঘটবে বা এই বিপদ হবে…সেই বিপদ হবে ইত্যাদি। এই জাতীয় ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করা মহান আল্লাহর সাথে শিরকও হতে পারে।

◉ চতুর্থ ও সর্বশেষ কারণ হল:

যদি সুরাইয়া তারকা উদিত হওয়ার পরও বালা-মসিবত না কাটে তাহলে লোকেরা আমাদের দীন সম্পর্কে কী বলবে? আমরা তো এটিকে দীনের সাথে জুড়ে দিয়েছি কিন্তু ‘মহামারী উঠে যাওয়া’ যে উক্ত হাদিসের অর্থ তা কিন্তু সাব্যস্ত নয়। তাহলে এখানে আমরা আমাদের দ্বীন ইসলামকে দুশমনদের হাসিঠাট্টার বস্তুতে পরিণত করছি অথচ এটার আমাদের কোন প্রয়োজন ছিল না।

সুতরাং হে আল্লাহর বান্দা, তোমার জন্য আবশ্যক হল শরিয়ত সম্মত এবং মেডিকেল ও ডাক্তারি নির্দেশনা মোতাবেক রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদেরকে তার সন্তুষ্টি মূলক কাজ করার তৌফিক দান করেন এবং এই বিপদকে উঠিয়ে নেন।
সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর।
অনুবাদক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জবাইল দাওয়াহ সেন্টর, সৌদি আরব

সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হলে মহামারী উঠে যাবে মর্মে বর্ণিত হাদীসটি সহিহ নয়:
(মুহাদ্দিসদের মতামত ও বিশ্লেষণ)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬
‘সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হলে মহামারী উঠে যাবে’ মর্মে বর্ণিত হাদীসটি সম্পর্কে
মুহাদ্দিসদের মতামত ও পর্যালোচনা তুলে ধরা হল:
عن أبي هريرةَ رضي اللهُ عنه قال: قال صلَّى اللهُ عليه وسلَّم: «إذا طلَع النَّجمُ؛ رُفِعَتِ العاهةُ عن أهلِ كُلِّ بلدٍ»
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “যখন তারাটি (সুরাইয়া) উদিত হবে, তখন প্রতিটি শহরবাসী থেকে ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে”।
⁩⁦
■ তাখরীজ:

হাদীসটি কখনও মারফু (রাসূল সা. এর মুখনিসৃত বাণী) আবার কখনও মাওকুফ (সাহবীর উক্তি) হিসেবে আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহুর সূত্রে আতা বিন আবী রাবাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং এই আতা রাহিমাহুল্লাহই হচ্ছেন সকল রেওয়ায়েতের কেন্দ্রবিন্দু। তার থেকে দু’জন রাবী হাদিসটি বর্ণনা করেছেনঃ
● (১) ইমাম আবু হানিফা‌ রাহিমাহুল্লাহ। তার থেকে হাদীসটি একাধিক সূত্রে এবং বিভিন্ন শব্দে কখনও মারফু আবার কখনও মাওকুফ হিসেবে এসেছে।
মারফুঃ [তাবরানী, মু’জামুস সগীর, ১০৪; ইমাম ত্বাহাবী, মুশকিলুল আছার,২২৮২; ইবনু আদী, আল-কামেল, ৮/২৪৪; আবু নুয়াইম, হিলইয়া, ৭/৩৬৭; আল-খালিলী, ইরশাদ, ৫৪।]
মাওকুফঃ (কাযী আবু ইউসুফ, আল-আছার, ৯১৭।)
● (২) ইসল বিন সুফিয়ান আল ইয়ারবুয়ী রাহিমাহুল্লাহ। তার থেকেও হাদীসটি একাধিক সূত্রে ও বিভিন্ন শব্দে কখনও মারফু আবার কখনও মাওকুফ হিসেবে এসেছে।
মারফুঃ [আহমদ, ৮৪৯৫; ত্বাহাবী, মুশকিলুল আছার, ২২৮৬; আল-বায্যার, কাশফুল আসতার, ১২৯২; ইবনু আব্দীল বার, তামহীদ, ২/১৯২।]
মাওকুফঃ [ইবনু আদী, কামেল, ৮/২৪৫, ঊকায়লী, আদ্বদ্বুয়াফা’, ৩/৪২৬।]

■ হাদীসটির মান: যঈফ।

ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, হাদীসটির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আতা বিন আবি রাবাহ রাহিমাহুল্লাহ এবং আতা থেকে দু’জন রাবী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন; ইমাম আবু হানিফা এবং ইসল বিন সুফিয়ান।

➤ ইমাম আবু হানিফা রহ.:

তিনি ফিকহের ক্ষেত্রে একজন ইমাম তবে হাদীসের ক্ষেত্রে সকল হাদীস সমীক্ষকদের মতে স্মরণশক্তি দিক থেকে একজন যঈফ রাবী (দুর্বল বর্ণনাকারী)। এমন অনেকেই আছেন যারা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের ইমাম অথচ অন্য ক্ষেত্রে যঈফ। যেমনঃ হাফস বিন সুলাইমান, কিরাতের ক্ষেত্রে তিনি একজন ইমাম ও হুজ্জত (শক্তিশালী প্রমাণ) অথচ হাদীসের ক্ষেত্রে যঈফ (দুর্বল)।

➤ ইসল বিন সুফিয়ান:

তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মতামত নিম্নরূপ:
● ইবনু মাঈন বলেন, যঈফ।
● ইমাম নাসায়ী বলেন, ليس بالقوي “তিনি শক্তিশালী নন।”
● ইবনু আদী বলেন, তিনি যঈফ সত্ত্বেও তার হাদীস লেখা যাবে।
● ইবনু সা’দ বলেন, যঈফ।
● ইমাম বুখারী এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আতা থেকে তার হাদীস বিতর্কিত।
● উকায়লী বলেছেন, আতা থেকে তার হাদীস সংশয়পূর্ণ।

উভয় বর্ণনাকারী যঈফ হওয়ার পাশাপাশি হাদীসটি মারফু না কি মওকুফ তা নিয়েও মতবিরোধ রয়েছে, যা দূর্বলতাকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়।

তবে কেউ কেউ আবু সাঈদ খুদরীর হাদীসটিকে উপরোক্ত হাদীসের শাহেদ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তা শাহেদ হওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। কেননা সেটিও যঈফ রাবীদের সূত্রে বর্ণিত।
حدثنا محمد بن ابراهيم بن ناصح قال حدثني محمد بن عيسى قال حدثني احمد بن أبي طيبة عن ابن أبي ليلى عن عطية عن أبي سعيد الخدري مرفوعا بلفظ : « ما طلع النجم ذا صباح إلا رفعت كل آفة وعاهة في الأرض، أو من الأرض ، .
হাদীসটি ইবনু আদী তার ( الكامل فى ضعفاء الرجال) গ্রন্থের ষষ্ঠ খণ্ডের ৪৫১ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। কিন্তু একমাত্র আহমাদ বিন আবু তাইবা ব্যতীত সনদের অন্যান্য সকল বর্ণনাকারী যঈফ।

■ যে সকল মুহাদ্দীসগণ সুরাইয়া তারকা সংক্রান্ত হাদীসটিকে যঈফ বলেছেনঃ

● ১. ইতিপূর্বে ইমাম বুখারী ও উকায়লীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
● ২. ইবনু আদী (কামেল, ৮/২৪৫)
● ৩. ইবনুল কায়সারানী (যাখিরাতুল হুফ্ফাজ, ১/২৭৬)
● ৪ খালিলী (আল-ইরশাদ ১/৩১৯)
● ৫. আবুল ওয়ালিদ আল বাযী (মুনতাকা শারহুল মুয়াত্ত, ৪/২২২)
● ৬. বুসীরী ( ইতহাফুল খিয়ারাহ, ৩/৩২৭)
● ৭. আলবানী (সিলসিলা যঈফাহ, ৩৯৭)
[সূত্রঃ আসনাল মাতালীব, পৃষ্ঠা নংঃ ৪৩ এবং আনীসুস সারী, ১/৪০৬]

■ হাদিসে বর্ণিত عاهة (বিপদাপদ ও রোগ-বালাই) শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্যঃ

হাদীসে বর্ণিত عاهة (বিপদাপদ ও রোগ-বালাই) শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে আলেমগণ মতবিরোধ করেছেন। যেমন:
● ১. হাদীসে বর্ণিত عاهة শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ মহামারী, তাঊন (প্লেগ) ও অন্যান্য রোগ-বালাই। [আবুল মোজাফফর আস-সামআনী তার তাফসীর গ্রন্থে এ ব্যাখ্যাটি করেছেন। (৬/৩০৬)]
● ২. এটা ফল-ফলাদির সাথেই নির্দিষ্ট। আর বিপদ উঠিয়ে নেওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হল, ফলের পরিপক্কতা প্রকাশ পাওয়া।
হাদীসের অধিকাংশ ব্যাখ্যাকারক এমনটিই ব্যাখ্যা করেছেন।
● ৩. আবু জাফর আত তাহাবী বলেনঃ যে জিনিসটি থেকে রোগ-বালাই উঠিয়ে নেওয়া হবে, তা হল খেজুর ফল। (মুশকিলুল আছার, ৬/৫৬)।
● ৪. মহীউস সুন্নাহ ইমাম আল-বাগাবী বলেনঃ عاهة দ্বারা উদ্দেশ্য এমন বিপদাপদ ও রোগ-বালাই যা ফলফলাদি বা শস্যে পতিত হয়। (শারহুস সুন্নাহ, ৮/৯৪)।
[লাইস বিন আমীন, আল-মুহায়্যা ফি হাদীসি তুলুইস সুরাইয়া]

আযহারুল ইসলাম
মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
২২/০৪/২০২০ইং
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সৌদি আরব
——————–
➤ ১২ মে ২০২০ রমজানেই মহামারী করোনার পরিসমাপ্তি প্রসঙ্গে এক আমেরিকান মুফতির বক্তব্যের প্রতিবাদ: শাইখ আজমল হোসাইন মাদানী
https://youtu.be/F-malOH8LuQ

Share: