পুরুষের শিরোভূষণ পাগড়ি

বুখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদীছগ্রন্থের সহীহ হাদীছসমূহের আলোকে নিশ্চিতরূপে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী-সাহাবীরা সভা-সমাবেশ, যুদ্ধকাল ও ওয়াজ-নসীহতের সময় পাগড়ি পরিধান করতেন। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথায় শোভা পাচ্ছিল পাগড়ি। সাহাবী জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- دَخَلَ مَكَّةَ دَخَلَ يَوْمَ فَتْحِ مَكَّةَ – وَعَلَيْهِ عِمَامَةٌ سَوْدَاءُ بِغَيْرِ إِحْرَامٍ.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ের দিন ইহরাম ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় ছিল একটি কালো পাগড়ি।’ [মুসলিম : ৩৩৭৫]
খুতবা প্রদানকালে তিনি পাগড়ি পরতেন। সাহাবী আমর ইবন হুরাইস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
كَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَلَى الْمِنْبَرِ وَعَلَيْهِ عِمَامَةٌ سَوْدَاءُ قَدْ أَرْخَى طَرَفَيْهَا بَيْنَ كَتِفَيْهِ.
‘আমি যেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি মিম্বরে বসে খুতবা দিচ্ছেন আর তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে একটি কালো পাগড়ি, যার দুই প্রান্ত তিনি তাঁর দুই কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছেন।’ (মুসলিম : ২/৯৯০)
আরেক হাদীসে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
خَرَجَ رَسُولُ اللَّهِ – صلى الله عليه وسلم – وَعَلَيْهِ مِلْحَفَةٌ ، مُتَعَطِّفًا بِهَا عَلَى مَنْكِبَيْهِ ، وَعَلَيْهِ عِصَابَةٌ دَسْمَاءُ حَتَّى جَلَسَ عَلَى الْمِنْبَرِ
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের উদ্দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর গায়ে জড়ানো ছিল একটি চাদর যা দিয়ে তাঁর দু’কাঁধ পেচিয়ে ছিল আর তাঁর মাথায় ছিল কালো কাপড়ের ইসাবাহ (এক ধরনের পাগড়ি)। এভাবেই তিনি মিম্বারে উপবিষ্ট হয়ে খুতবা প্রদান করলেন।’ [বুখারী : ৩৮০০]
সাধারণ সময়ও তাঁর মাথায় সৌন্দর্য বর্ধন করত এই পাগড়ি। সালাতের প্রস্তুতিপর্বে যখন অজু করতেন তখনও এটি তার মাথায় লেপ্টে থাকত। সাহাবী মুগিরা ইবন শু‘বা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَوَضَّأَ فَمَسَحَ بِنَاصِيَتِهِ وَعَلَى الْعِمَامَةِ وَعَلَى الْخُفَّيْنِ
‘নবী ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজু করলেন, এতে কপালের উর্ধ্বাংশে এবং পাগড়ি ও মোজার ওপর মাসেহ করলেন।’ [মুসলিম : ৪১২]
শুধু নিজেই পরেননি, সাহাবীদের তিনি বিভিন্ন সময় পাগড়ি পরিয়েও দিয়েছেন। বিশেষত কাউকে সেনাপতি বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণকালে তিনি তাকে নিজ হাতে পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছেন বলে একাধিক সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।
সাহাবায়ে কেরামের পাগড়ি : সাহাবায়ে কেরামের পাগড়ি পরিধান সম্পর্কেও বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল্লাহ ইবন দিনার (রহ.) বলেন,
أَنَّ رَجُلاً مِنَ الأَعْرَابِ لَقِيَهُ بِطَرِيقِ مَكَّةَ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأْسِهِ فَقُلْنَا لَهُ أَصْلَحَكَ اللَّهُ إِنَّهُمُ الأَعْرَابُ وَإِنَّهُمْ يَرْضَوْنَ بِالْيَسِيرِ. فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ».
‘একবার হজের সফরে মক্কার পথে এক বেদুঈন আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আবদুল্লাহ তাঁকে সালাম দেন এবং তাকে নিজের বাহন গাধার পিঠে বসিয়ে নেন। আর নিজ মাথা থেকে পাগড়ি খুলে তাকে দিয়ে দেন। আমরা তাঁকে বললাম, এরা তো বেদুঈন, এরা তো অল্পতেই খুশি হয় (এত বড় উপহার দেয়ার কী দরকার ছিল?)। আবদুল্লাহ বললেন, এর বাবা আমার পিতা উমর ইবন খাত্তাবের বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “পিতার সেবাযত্নের পদ্ধতি হলো, পিতার প্রিয় মানুষদের সেবাযত্ন করা।”’ [মুসলিম : ৬৬৭৭]
এছাড়া ঈদের দিনে সাহাবায়ে কেরাম সবিশেষ পাগড়ি পরতেন বলে কোনো কোনো হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। [মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা : ৫/১৭৮; বাইহাকী : ৫/১৭৪]
যেভাবে পাগড়ি পরতেন : তাবেঈ আবু আবদুস সালাম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ ইবন উমরকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে পাগড়ি পরিধান করতেন? তিনি বললেন, “পাগড়ি তিনি মাথায় পেচিয়ে নিতেন, পেছন দিক থেকে গুজে দিতেন এবং প্রান্তদ্বয় উভয় কাঁধের মাঝ বরারব ঝুলিয়ে দিতেন।”’ [মাজমাউয-যাওয়ায়েদ : ৫/১২০; হাদীছটির সূত্র গ্রহণযোগ্য]
পাগড়ির রঙ : উপর্যুক্ত মুসলিম ও বুখারীর বর্ণনাসহ অধিকাংশ হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায়, সফরে ও যুদ্ধেক্ষেত্রে কালো রঙের পাগড়ি পরেছেন। কালো রঙ ছাড়া হলুদ রঙের পাগড়ি পরেছেন বলেও কিছু দুর্বল সূত্রের হাদীছ উল্লেখ রয়েছে। তবে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হলুদ পাগড়ির প্রচলন ছিল। বদরের যুদ্ধে তাঁরা ফেরেশতাদের মাথায় হলুদ পাগড়ি দেখেছেন বলেও গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীদেরকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদা রঙের পাগড়ি পরিয়েছেন এবং একে সমর্থন করেছেন বলেও হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আবদুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে সেনাপতি বানানোর সময় তিনি সাদা পাগড়ি পরিয়েছেন। [মুসনাদ আহমদ : ৪/৫৮৩]
এছাড়া সাহাবায়ে কেরাম সবুজ ও লাল রঙের পাগড়ি পরেছেন বলেও হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে।
পাগড়ির ফযীলত সম্পর্কে বিশেষত নামাজের জন্য পাগড়ির ব্যবহার সম্পর্কে কোনো গ্রহণযোগ্য সনদের হাদীছ পাওয়া যায় না। কিন্তু যেহেতু রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে পাগড়ি পরেছেন, অন্যদের পরিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম ও সবযুগের পুণ্যবানরা পাগড়ি পরেছেন তাই এবং নামাজে আল্লাহ তায়ালা যে সৌন্দর্য অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন তার অংশ হিসেবে পাগড়ি ব্যবহার করা হলে তা অবশ্যই কাম্য ও উত্তম বলে গণ্য হবে। এ কথা বলাবাহুল্য যে একজন আল্লাহর প্রতি সমর্পিত ও তাঁর রাসূল ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত অনুসারীর বেলায় পাগড়ি ব্যবহার ও এতে উৎসাহিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে তার প্রিয় রাসূল এটি পরেছেন এবং অন্যদের পরিয়েছেন আর তাঁর প্রকৃষ্ট অনুসারী শ্রেষ্ঠ মানুষদের কাফেলা সাহাবায়ে কেরামও তার অনুকরণ করেছেন।
তবে এটাকে মুত্তাকী বা পরহেজগারদের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলা বা ইমাম-খতীবের মাথায় পাগড়ি না দেখে ভর্ৎসনা করা উচিত নয়। তাকওয়ার আসল পরিচয় পোশাকে নয়; আল্লাহর ভয়ে গুনাহ বর্জনের মাধ্যমেই তাকওয়ার প্রকাশ ঘটে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই এমন ঘটনার অবতারণা করা হয়ে থাকে। কারণ, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাগড়ি পরেছেন এবং পরিয়েছেন আরবীয় পোশাক ও ঐতিহ্য হিসেবে। তিনি এর জন্য কাউকে নির্দেশ দেননি বা তার থেকে কোনো ফযীলতের বর্ণনা সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়। আল্লাহ আমাদেরকে শরীয়তের সব বিষয়ে সঠিক অবস্থান ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(ড. খোন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর সংকলিত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পোশাক ও পোশাকের ইসলামী বিধান গ্রন্থ অবলম্বনে)